আমি একজন পরিপূর্ণ শিল্পীই হতে চাই : সায়ন্তনী চক্রবর্তী বিনোদন /  সাক্ষাৎকার / 
ভারতীয় নৃত্যশিল্পী সায়ন্তনী চক্রবর্তী। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয় ও অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘টাইমটাচ নিউজ ডটকম’ এর সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক ফয়সাল হাবিব সানি।
টাইমটাচ নিউজ: কেমন আছেন? জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে নৃত্যকে ঘিরে আপনার বর্তমান ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাই?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: ভালো আছি আপনাদের ভালোবাসায়। তবে জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠতে এখনও অনেকটা পথ বাকি। যেকোনো শিল্পই হলো সাধনা আর সাধনার পথ অনেক দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। বর্তমানে নৃত্যকে ঘিরে তো ব্যস্ততা চূড়ান্ত। কেননা নাচকে কেন্দ্র করেই আমার সবকিছু; বলতে পারেন একটা দিব্যি সংসারের মতো। নৃত্য অনুশীলন, জব এবং তার মাঝে বিভিন্ন শো তো থাকেই। সর্বোপরি, সুন্দর, স্নিগ্ধ, মিস্টি ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে।
টাইমটাচ নিউজ: নৃত্যে কীভাবে আপনার হাতেখড়ি হলো সেই গল্পটা যদি সংক্ষেপে বলতেন?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: তখন ২০০০ সাল, সম্ভবত এপ্রিল মাস আর আমার বয়স সবেমাত্র আড়াই বছর। আমার মা (পিসি) মেদিনীপুরে একজন নৃত্য শিক্ষিকার কাছে আমায় নৃত্য শিখতে ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি হলেন সুতনুকা চ্যাটার্জী। উনার কাছেই আমার নৃত্যের হাতেখড়ি। উনার কাছেই আমি প্রথম ধ্রুপদী নাচের তালিম নিতে শুরু করি। শৈশব থেকেই আমি ভারতনাট্যম শিখে এসেছি। আর নৃত্য শেখাতে এর জন্য আমার কাছ কখনো কোনো অর্থ নেননি তিনি। গুরুদক্ষিণা হিসেবে আমি যেন নৃত্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারি এইটুকুই সর্বদা কাম্য ছিল উনার। তবে আমায় নৃত্যে ভর্তি করার বিষয়টা অনেকের কাছে তখন দৃষ্টিকটু মনে হলেও নিজের ইচ্ছে আর অদম্য স্পৃহায় নৃত্যটাই চালিয়ে যাচ্ছি আজও। নৃত্যটাকেই মূলত আমি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে একই সুতোয় বেঁধে ফেলেছি।
টাইমটাচ নিউজ: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি মণিপুরী নৃত্যের উপর উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও নৃত্যের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততার গল্পটা কিংবা ওই সময়ের কোনো স্মৃতির কথা জানতে ইচ্ছুক?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা আমার কাছে আমার জীবনের অত্যন্ত স্বর্ণালী সময় কিংবা স্বর্ণযুগও বলতে পারেন। আমার অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্য নিয়ে অধ্যয়ন করার বিষয়টা। অবশ্য গতানুগতিক ধারা থেকে কিছুটা বের হয়ে নতুন কিছু নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল আমার আর আমার ভাগ্যে সেইটাই হয়েছে। শান্তিনিকেতনে অবস্থিত এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমি মণিপুরী নৃত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। ওখানকার পরিবেশটা এতটাই শৈল্পিক যে, নাচ, গান, ছবি আঁকা যেন ওই পরিবেশেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং একটি অন্যের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পর্কযুক্ত। যেই মূল্যবান সময়গুলো আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গুরুদের কাছ থেকে নৃত্যে তালিম নিতে পেরেছি এবং নৃত্যের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয়েছি তা সত্যিই অমূল্য। কত শিল্পী একই আকাশের নিচে বসে একসঙ্গে শিখেছি, জেনেছি তার যেন কোনো অন্ত নেই। স্মৃতি তো অনেক রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে কেন্দ্র করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সকাল ৬ টায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনৃত্যের ক্লাস থাকত আমাদের। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে পৌঁছাতাম নাচের ক্লাসে। কেউ ঘুম ঘুম চোখে, কেউ-বা হাই তুলে দাদার জন্য অপেক্ষা করতাম উনি কখন আসবেন। উনি এলেই আমরা সকলে কোমর বেঁধে নৃত্যের তালিম নিতে প্রস্তুত হতাম; সেই নৃত্য ছিল এক অদ্ভুত মাধুর্যে সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যে চির রঙিন। দাদা সকলের নাম মনে রাখতে পারতেন না; তাই প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করতেন, ‘কার কোথায় বাড়ি’? যার যেখানে বাড়ি, সেই স্থানের নাম ধরেই ডাকতেন। আমায় ডাকতেন ‘নবাক্ষী' নামে, চশমা পরতাম যেহেতু। সেই দিনগুলো সত্যিই ছিল হৃদয়গ্রাহী ম্যাজিক এক স্মৃতিমুখর দিন, আনন্দের দিন, মজার দিন। অন্যদিকে, আমাদের শান্তিনিকেতনকে আরও বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলার প্রয়াসও ছিল আমাদের নিজেদেরই। ফুলের গয়না তৈরি করতাম আমরা। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে টগর ফুলের কুঁড়ি, কাঠাল পাতা, রঙ্গন ফুল সবকিছু যোগাড় করে এনে গলার মালা, কানের দুল, টিকলি, মাথার মুকুট তৈরি করতাম সকলে মিলে। তাছাড়াও, শান্তিনিকেতনের আল্পনা, ভাস্কর্য, পরিবেশ, বিভিন্ন উৎসবে দেশ-বিদেশের নানান বন্ধুর পদচারণাই মুখরিত ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানা রঙের বর্ণিল দিনগুলো। সে যেন সবমিলিয়ে এক অন্যরকম তাঁরাদের হাট!
টাইমটাচ নিউজ: নৃত্যের পাশাপাশি আপনি তো বিভিন্ন ধরণের ফটোশুটও করে থাকেন। পূর্বে মডেলিং করা হয়েছে বা এখন করা হচ্ছে কী?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: আমি প্রফেশনালি একজন নৃত্যশিল্পী। এর পাশাপাশি আমি একাদশ শ্রেণি থেকে মডেলিং করেছি এবং অনেক ফটোশুটও করা হয়েছে আমার। বর্তমানে অন্যান্য কাজের চাপে তেমন করে উঠতে পারি না। তবে সময় সুযোগ মিলিয়ে মডেলিং করা সম্ভব হলে নিশ্চয়-ই করব। এটি আমার খুব পছন্দের একটা পেশা; তাই এমন কাজের সঙ্গে নিজে সম্পৃক্ত থাকতে পারলে ভালোই লাগবে।
টাইমটাচ নিউজ: ভবিষ্যতে অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে দেখতে চান কি-না? আর অভিনেত্রী হলে কোন প্ল্যাটফর্মে নিজেকে মেলে ধরতে চান ও কোন ধরণের কাজ বেশি করতে চান?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: ভবিষ্যতে একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে দেখতে চাই। কিন্তু আমি একজন পরিপূর্ণ শিল্পীই হতে চাই সবকিছুর আগে আমার যোগ্যতা, মেধা ও পরিশ্রমের সম্মিলনে। প্রথমত, আমার থিয়েটারে কাজ করার প্রবল ইচ্ছে রয়েছে; খুব ইচ্ছে গভীরে গিয়ে এগুলো বিষয়ে জানার, বোঝার ও শেখার। কাজ করলে বাস্তবধর্মী জীবনমুখী চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোই করতে চাই।
টাইমটাচ নিউজ: নিজের অনিন্দ্য অসাধারণ প্রতিভার দরুণ পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। ওপার বাংলা (ভারত) ছাড়াও তো এপার বাংলার (বাংলাদেশ) মানুষের কাছ থেকে শুভকমনা, ভালোবাসা পান এবং পাচ্ছেনও। এই যে বাংলাদেশের মানুষও যখন আপনার কাজকে পছন্দ করেন, তখন কেমন অনুভূতি হয় নিজের?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: অত্যন্ত আনন্দবোধ করি। এই ভালোবাসার অনুভূতিতে এপার-ওপার বাংলাকে আমার আলাদা কিছু মনে হয় না৷ মনে হতে থাকে যে, দুই বাংলার মানুষের সাথেই আমার দীর্ঘদিনের আত্মিক সম্বন্ধ। আমি আপ্লুত আপনাদের ওপার বাংলার (বাংলাদেশ) মানুষের কাঙ্খিত ভালোবাসায়। এভাবেই আমাকে ভালোবাসতে থাকুন, আমার কাজকে ভালোবাসতে থাকুন।
টাইমটাচ নিউজ: এসবের বাইরেও আপনার প্রিয় শখগুলো কী কী এবং নিজের জীবনকে কীভাবে উদযাপন করতে ভালোবাসেন আপনি?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: আমার অনেকগুলো প্রিয় শখ রয়েছে। যেমন ফটোগ্রাফি, আর্ট গ্যালারি পরিদর্শন, হারিয়ে যাওয়া কোনো এক নাম না জানা রাস্তায় বেরিয়ে পড়া, ঘর সাজানো প্রভৃতি। এছাড়াও, নিজের জীবনকে উদযাপন করার জন্য শপিং করতে ভালোবাসি, আমার বাড়ির পশু-পাখিদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাতে ভালোবাসি এবং হুট করে কোথাও ঘুরতে বের হয়ে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টাকে বেশ ইনজয় করি আমি।
টাইমটাচ নিউজ: আপনি আপাদমস্তক একজন শিল্পী। শিল্পীরা স্বাধীনচেতা হয়, বাঁধনহারা হয়; জীবনকে রাঙাতে চায় একান্তই তাদের নিজস্ব আলোয়, স্বাতন্ত্র্যতায়। শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিল্পী এই তিনটা বিষয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিল্পী বিষয় তিনটা তো একে অপেরর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিল্প রয়েছে বলেই তো সংস্কৃতির একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে আর এই শিল্প থেকেই তো শিল্পীর সৃষ্টি। তাই এই বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করতে গেলে বলতে হয়, তারা একে অন্যের সম্পূর্ণ পরিপূরক। কোনোটাকে বাদ দিয়েই যেন কোনোটাকে চিন্তা করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। শিল্প, সংস্কৃতি রয়েছে বলেই তো যুগের পর যুগ ধরে নানান ধরণের শিল্পীদের আনাগোনা ঘটেছে এবং ঘটছে এই পৃথিবীতে আর শিল্পীরা আছে বলেই তো পৃথিবী এতটা সুন্দর আর পৃথিবীকে এতটা বেশি মায়াবী, প্রেমময়, ভালোবাসাময় মনে হতে থাকে আমাদের সকলের কাছেই।
টাইমটাচ নিউজ: এবার আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলুন?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নৃত্যে ডক্টরেট করা আর মণিপুরী নৃত্যের সুদুরপ্রসারী উৎকর্ষে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। যেইটা আমার ছোটবেলা থেকেই ভীষণ স্বপ্নের আর প্রচণ্ড আগ্রহেরও একটা বিষয়। এসবের বাইরেও অবহেলিত, দুস্থ, পথশিশুদের জন্য বৃহৎ পরিসরে কিছু করতে চাই এবং নৃত্য নিয়ে অনেক বেশি সৃষ্টিশীল কাজ করে যেতে চাই আমৃত্যু আজীবন।
টাইমটাচ নিউজ: সবশেষে একটাই প্রশ্ন, সামনের দিনগুলোতে নিজেকে কোন অনন্য শিখরে মেলে ধরতে চান কিংবা অধিষ্ঠিত করতে চান?
সায়ন্তনী চক্রবর্তী: সামনের দিনগুলোতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই একজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেখতে চাই নিজেকে এবং একজন ভালো ও আদর্শবান মানুষ হিসেবেই নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণরূপে মেলে ধরতে চাই। আমার কাজের মাধ্যমেই মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে চাই এবং সর্বক্ষণই মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকতে চাই আমার হৃদয় ও হাত দুটি প্রসারিত করেই।
ছবি: সংগৃহীত