Opu Hasnat

আজ ১৩ জুন শুক্রবার ২০২৫,

পৃথিবীর সকল শিল্পীই এক একটি বই : নুশিন আদিবা বিনোদনসাক্ষাৎকার

পৃথিবীর সকল শিল্পীই এক একটি বই : নুশিন আদিবা

এ প্রজন্মের দর্শকপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নুশিন আদিবা। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হয়েছেন দেশের পাঠকপ্রিয় ও তথ্যসমৃদ্ধ অনালইন নিউজ পোর্টাল ‘টাইমটাচ নিউজ ডটকম’ এর সঙ্গে। তার সংগীতচর্চা সম্পর্কিত ও সংগীতের বৃহৎ পরিসরের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ফয়সাল হাবিব সানি। 

টাইমটাচ নিউজ: কেমন আছেন? সংগীত নিয়ে বর্তমানের ব্যস্ততা কেমন? 

নুশিন আদিবা: আলহামদুলিল্লাহ্। সবমিলিয়ে ভীষণ ভালো যাচ্ছে সময়। বর্তমানে আসলে শো চলছে টানা। নতুন একটা মৌলিক গান নিয়ে কথা চলছে, বেশ কিছু টিভি প্রোগ্রাম করা হয়েছে; এইসব নিয়েই দারুণ উপভোগ্য ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে মুহূর্তগুলো। 

টাইমটাচ নিউজ: ‘চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ-২০১৭’ এর ফাইনালিস্ট ছিলেন আপনি৷ মূলত, সংগীতের সঙ্গে আপনার নিজেকে সম্পৃক্তকরণের গল্পটা সংক্ষেপে জানতে চাই?
 
নুশিন আদিবা: সংগীতের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা বহু পুরোনো। শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে আমি। আমি স্কুলে ভর্তি হবার পূর্বে আমাকে হারমোনিয়াম কিনে দেয়া হয়েছিল। আমার মা নাচ করতেন, সেই প্রভাবটা অর্থাৎ সংস্কৃতির আবহ আমার জীবনে ভালোভাবেই প্রভাব ফেলেছে বলা যেতে পারে। সংগীতে হাতেখড়ি নাসের চৌধুরী স্যারের কাছে। সুর সম্রাট ‘দি আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন’ এ হেলাল আহমেদ স্যারের কাছে ক্লাসিক্যাল শিখেছি। সেই সাথে ‘তিতাস ললিত কলা একাডেমি’ থেকে মুক্তিযোদ্ধা সেহেলি মাসুদ ম্যাম (সদ্য প্রয়াত), আলী মোসাদ্দেক মাসুদ স্যার, ‘শিল্পকলা একাডেমি’ থেকে পীযুষ কান্তি আচার্য্য স্যার এর কাছে শিখেছি। আর সুজিত মোস্তফা স্যারের কাছে পরবর্তীতে ভোকাল ট্রেনিং করেছি। তবে হ্যাঁ, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক স্যারের কাছে গান পরিবেশনার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু জ্ঞান লাভ করেছি। গানের অনুভব, অভিব্যক্তি প্রকাশ, মঞ্চ নাটক এর জন্য গান এইসব বিষয়ে উনার কাছে থেকে শেখা প্রতিটি শব্দ আমাকে প্লেব্যাক শিল্পী তথা মানুষ হিসেবেও আরো পরিপক্ক করছে প্রতিনয়ত।
 
টাইমটাচ নিউজ: শৈশব থেকেই কী ভাবতেন একদিন একজন কণ্ঠশিল্পী হবেন? 

নুশিন আদিবা: শৈশব থেকেই কন্ঠশিল্পী হবো ভেবেছি ঠিক বলা যায় না। কেননা ছোটবেলায় গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় সবই শিখেছি গুরুর কাছে গিয়ে। মূলত, চিত্রশিল্প  ছাড়া প্রায় সব ‘Performing Art’ মোটামুটি শেখার চেষ্টা করতাম। বলতে গেলে, আমি ছবি অঙ্কন করতে একদমই পারি না। একটা মজার ঘটনা আছে এই বিষয়ে, ছবি অঙ্কন শিখতে যখন আম্মু পাঠিয়েছিল তখন পালিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার মনে হতো সেখানে কোন শব্দ নেই, কেমন গুমোট লাগত; তাই হয়তো ছবি অঙ্কন করাটা এত কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছিল আমার কাছে। তবে ইদানিং আফসোস হয়। এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছবি অঙ্কনের আগ্রহ খুব বেশি টানছে আমায়। 

টাইমটাচ নিউজ: সংগীতেরও তো অনেক শাখা রয়েছে। কী ধরণের গান করতে বেশি পছন্দবোধ করেন বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? 

নুশিন আদিবা: বিশেষত, আমার ক্লাসিক্যাল আর নজরুল সংগীত দিয়েই গান শেখাটা শুরু হয়েছিল। এখন তো  পেশার ক্ষেত্রে সব ধরনের গান-ই গাইতে হয়, বিভিন্ন ভাষার গানও গাইতে হয়। তবে আধুনিক , নজরুলগীতি গাইতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আর শ্রোতা হিসেবে যদি বলতে হয়, আমার প্লে লিস্ট ভীষণ  রঙিন। বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন স্টাইলের  র‍্যাপ, হিপহপ প্রায় সব শাখার গানেরই সেখানে উপস্থিতি থাকে। 

টাইমটাচ নিউজ: কণ্ঠশিল্পী না হলে নুশিন আদিবা জীবনে কী হতে চাইতেন? 

নুশিন আদিবা: এই ভাবে তো ভেবে দেখে নি (হা হা হা...)। তবে ‘Culinary Artist' হতাম হয়তো। রান্না করাটা আমার ভীষণ পছন্দের কাজ। 

টাইমটাচ নিউজ: বিভিন্ন গান আপনার কণ্ঠে নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং বিভিন্ন মৌলিক গানও করেছেন। যদি বলি, তাহলে কোন গানটিকে নিজের সংগীত ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট মনে করেন? 

নুশিন আদিবা: হ্যাঁ, বেশ কিছু মৌলিক গান আছে।  নাটকের গান, ওয়েব সিরিজের গান, বিজ্ঞাপনের গানও করা হয়েছ অনেক। ‘হাই বেবি’, ‘কাজল দীঘি’, ‘নিশার আঁধার সাক্ষী’, ‘কোন সে জাদু করিয়া’, ‘তোমার লেখা চিঠির মাঝে’, ‘পাগলপারা’, ‘কবিতার অন্ত্যমিল’ এইগুলো অন্যতম। সবগুলো মৌলিক গান-ই আমার ক্যারিয়ারে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। তবে ‘চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ’ এর মঞ্চে গাওয়া মিতালী মুখার্জী ম্যাম এর ‘দুঃখ ছাড়া হয়না মানুষ’, ‘তোমার চন্দনা মরে গেছে’ এই দুটি গান দর্শকশ্রোতা এতটা পছন্দ করেছে যে, এখনও আমাকে প্রায় সবখানেই এই গানগুলো গাইতেই হয়। স্বয়ং মিতালী মুখার্জী ম্যাম এই গানগুলো শুনে আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি আমার মধ্যে উনার প্রতিফলন দেখতে পান। এর থেকে বেশি কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য আমি আর কোনোদিনও পাব কি-না আমার জানা নেই। এমন একজন  জীবন্ত কিংবদন্তি যিঁনি কি-না স্বয়ং এই গানগুলোর মূল শিল্পী, তাঁর কাছ  থেকে  এমন শব্দ শুনতে পাওয়ার থেকে সংগীত ক্যারিয়ারে বিশেষ টার্নিং পয়েন্ট আর কী-ই বা হতে পারে!

টাইমটাচ নিউজ: সংগীতের বৃহৎ ভুবনে কাকে আপনার আদর্শ মনে করেন কিংবা সংগীত সাধনায় আপনার অনুপ্রেরণা কে বা কারা? 

নুশিন আদিবা: আমার সংগীত সাধনায় অনুপ্রেরণা আমার মা আর বিশেষ একজন হলো আমার নানু। অন্যদিকে, সংগীতের বৃহৎ ভুবনে আমার আদর্শ বলতে গেলে আমি সামিনা চৌধুরী, মিতালী মুখার্জী, লতা মঙ্গেশকর, শ্রেয়া ঘোষাল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু এর মতো মানুষের নাম নিতে চাই। আমি মূলত সকল শিল্পীদের কাছ থেকেই শেখার চেষ্টা করি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। পৃথিবীর সকল শিল্পীই এক একটি বই আর আমি তাঁদের কাছ থেকে শিখছি প্রতিনিয়ত। 

টাইমটাচ নিউজ: পড়াশুনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। পড়াশুনার পাশাপাশি সংগীত-ই আপনার ধ্যান, জ্ঞান ও সাধনা। এছাড়াও তো রয়েছে নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন৷ এত কিছু নিজেই কীভাবে সামলাচ্ছেন? 

নুশিন আদিবা: না, একা একা সামলাতে পারি না। মা আছেন, এর থেকে বড় সাপোর্ট হয় না আসলে। তবে হ্যাঁ, এইসব কিছু নিয়ে যে ব্যস্ততায় থাকতে পারি সেটা আমি ভীষণ উপভোগ করি। একদমই ঘরকুনো মানুষ নই আমি। সবকিছু সাথে নিয়ে জীবনকে উদযাপন করতে পছন্দ করি আমি।

টাইমটাচ নিউজ: সংগীত তো আপনার পেশা এবং নেশাও বটে। সংগীতের বাইরে আপনার প্রিয় কোনো শখ সম্পর্কে যদি বলতেন? 

নুশিন আদিবা: বিভিন্ন জায়গায়  ঘুরে বেড়ানো,  থিয়েটারে অভিনয়, নাচ, রান্না করা, সিনেমা দেখা, এমনকি ক্যামেরার পেছনের বিভিন্ন কাজে বেশ আগ্রহ পাই। এককথায় শখের শেষ নেই; লাখ টাকা পাওয়ার থেকে বেশি আনন্দ পাই এই কাজগুলো করে। নিজেকে তখন আরও বেশি জীবন্ত ও সজীব মনে হতে থাকে। 

টাইমটাচ নিউজ: বিশ্বের মানচিত্রে বাংলা সংগীতও তো প্রতিনিয়ত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। দেশের সংগীতের আরও উৎকর্ষ সাধনে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

নুশিন আদিবা: প্রকৃতপক্ষে, সংগীতের জগতে আমরা ক্রমশই ভীষণভাবে অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ছি। আগের দিনের গানগুলোর মধ্যে বিশেষ করে গানের কথায় যে মাধুর্যতা ছিল, নিজস্বতা ছিল এখন তার খুব অভাববোধ করি। গুরুর কাছে গিয়ে এখন মানুষ  শিখে না, ইউটিউব থেকেই নাকি সব শেখা যায়! এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন আমাদের। গুরুমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রকৃত অর্থে, গোড়াটা শক্ত করতে পারলে আর নিয়মানুবর্তিতায় থাকলে যে কোনো ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন হবেই।

টাইমটাচ নিউজ: সংগীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? 

নুশিন আদিবা: এই যে বলেছি সংগীতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছি আমরা এখন! তাই আমি চাই, এমন একটা ইন্সটিটিউটের সাথে যুক্ত থাকতে অথবা এমন একটি স্থান তৈরি করতে যা দেশের সহ পৃথিবীর সকল বড় মাপের সংগীত গুরুদের এক ছাদের নিচে নিয়ে এসে এই সময়ের উদীয়মান, প্রতিভাবান শিল্পীদের আরও বেশি বিস্তারিতভাবে সংগীতকে শেখার এবং বোঝার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে সমর্থ হবে। 

টাইমটাচ নিউজ: পরিশেষে জানতে চাই, অদূর ভবিষ্যতে নুশিন আদিবা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কোন অনন্য উচ্চতায় নিজেকে মেলে ধরতে চান বা দেখতে চান?

নুশিন আদিবা: জাতীয় পুরস্কার  পেতে চাওয়াটা তো অবশ্যই, সকল শিল্পীই চায়। কিন্তু কোনো পুরস্কার যদি না-ও পাই, তবুও আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। শুধু  এমন কিছু গান রেখে যেতে চাই, যা যুগ পেরিয়েও অমলিন থাকবে দর্শকশ্রোতাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। 

ছবি: সংগৃহীত