Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

খাগড়াছড়িতে পশুর হাটে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি, ব্যবসায়ী ও ইজারাদারের মাথায় হাত! খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়িতে পশুর হাটে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি, ব্যবসায়ী ও ইজারাদারের মাথায় হাত!

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে চেংগী নদীর পাড়ে বসেছে কোরবানির পশুর হাট, এতে ঘেঁষাঘেঁষি করে পশু কেনাকাটা করছে সাধারন মানুষ। সোমবার (১২ জুলাই) সকাল থেকে বসা এই হাটে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা গাঁ-ঘেঁষাঘেঁষি করে পশু কেনাকাটা করছে মানুষ। বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। কোরবানীর হাটে অবাধে বেচা-কেনায় ক্রেতা-বিক্রেতার সুবিধার্থে পুলিশ, ব্যাংক স্টাফ ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক বাজারে অবস্থান করতে দেখা গেছে। 

হাট ঘুরে দেখা যায়, হাজারের বেশি গরু-ছাগল হাটে এনেছেন বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা। তবে বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে আসলেও গরু-ছাগলের ক্রয়-বিক্রয়ের আমেজ ছড়িয়ে পড়েনি। জেলা সদর বাজারে গরু-ছাগলের কমতি না থাকলেও ক্রেতার উপস্থিতি কম। এতে খামারি-ব্যবসায়ী ও ইজারাদারের কপালে হতাশার চিহ্ন দেখা যায়। জেলা কোরবানীর পশুর হাটে প্রায় শেষ সময়ে এসে পশু বেচা-কেনায় ক্রেতারা স্বস্তিবোধ করলেও পুঁজি হারিয়ে অস্বস্তিবোধ করেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারী খামারী। ফলে ৯টি উপজেলার অর্ধশত খামারী ও মধ্যস্থভোগী বেপারী এ বছর গরু ব্যবসায় নাভিশ্বাস। সাধারন কৃষক পরিবার পুঁজি ফিরে পেয়ে কিছুটা স্বস্তিতে।

করোনা প্রতিরোধে কঠোর লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে প্রশাসনের প্রচার-প্রচারণা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে যেন সচেতনতা নেই। অভিযানের কথা শুনার শুনলেই মাস্ক পরাসহ অন্য বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠলেও ম্যাজিস্ট্রেট ফিরে যেতেই আগের চিত্র হয়ে দাড়ায়। সোমবার (১২ জুলাই) পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন শান্তিপুর গরুর হাট ও আশেপাশের কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। সোমবার ভোর থেকেই শান্তিপুর বাজারে ব্যাপক সমাগম ঘটে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ক্রেতা-বিক্রেতাদের। কেউ কোরবানী পশু বিক্রি করতে আবার কেউ কেউ পছন্দের কোরবানীর পশু কিনতে জড়ো হয় শান্তিপুর বাজারের কোরবানীর পশুর হাটে। কিন্তু সেখানে মানতে দেখা যায়নি স্বাস্থ্যবিধি।

মাটিরাঙ্গায় প্রশাসনের নানামুখী চেষ্টার পরেও জনগন সরকারী বিধিনিষেধ মানছেনা মন্তব্য করে সচেতন মহল মনে করেন, প্রশাসন-জনগন লুকোচুরি খেলা বন্ধ করা না গেলে করোনা প্রতিরোধ বা করোনা থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখা তো দূরের কথা মাটিরাঙ্গাসহ পুরো জেলার মানুষকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। শান্তিপুর বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অ.দা) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিজ ফারজানা আক্তার ববি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হলে হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের মুখে মাস্ক দেখা গেলেও প্রশাসনের লোকজন ফিরে যেতেই ফুটে ওঠে আগের চিত্র। এছাড়াও গরুর হাটে দেখা গিয়েছে অনেক মানুষের সমাগম। এমনকি সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে খোলা হচ্ছে প্রায় সব ধরনের দোকান-পাট।

লকডাউন বাস্তবায়নে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (অ.দা) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, কোরবানীর পশুর হাটগুলোতে কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে। একটি গরুর সাথে একজন বিক্রেতা ও ক্রেতা ব্যতিত অন্য কাউকে হাটে প্রবেশ করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

এদিকে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে কোরবানির জন্য জেলাতে প্রস্তুুত করা হয়েছে সাড়ে ২০মণ তথা ৮২০কেজি ওজনের একটি ষাঁড়। এটির হাঁটাচলা কিংবা হাঁকডাকে বেশ রাজকীয় ভাব। গঠন-গড়নেও হৃষ্টপুষ্ট। তাই নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজপুত্র’। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ আর দৈর্ঘ্য আট ফুট। বছর চারেক আগে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলা সদরের মুসলিমপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মো: ওয়ালীউল্লাহ অলির গোয়ালে জন্ম হয় ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়টি। পরিবারের সদস্যের মতোই লালন-পালন করেছেন তিনি। মোটাতাজাও করেছেন দেশীয় পদ্ধতিতে। ওয়ালীউল্লাহ অলি প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। বর্তমানে তিনি ঠিকাদারি ব্যবসার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত ও মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। তবে এই ষাঁড়টিকে লালন-পালন করেছেন অনেকটা শখের বশেই।

তার সহধর্মিণী সালমা অলি বলেন, খাবারের বেলায় বেশ আয়েশি আমাদের রাজপুত্র। একদম পরিচ্ছন্ন খাবার দিতে হয় তাকে। শুকনো খড়, বিভিন্ন প্রকার ডালের ভুসি, চালের কুঁড়া, তেল বীজের খৈল, চিটা গুড়, ছোলা ও গমের পাশাপাশি চাষ করা সবুজ ঘাস খেতে দেওয়া হয়। তবে রাজপুত্রের এখন সবচেয়ে বেশি পছন্দ খাগড়াছড়ির বিখ্যাত আম্রপালি আম।

ওয়ালীউল্লাহর দুই ছেলে আলী হায়দার শামীম ও শাহরিন হোসেন সজীব জানান, প্রতিদিন নিয়মিত ২-৩বার গোসল করানো হয় ষাঁড়টিকে। আর দৈনিক তার খাবার লাগে অন্তত ২০-২৫কেজি। তবে দিন দিন ওর খাবারের চাহিদা বাড়ছে।

মালিক এর দাম হাঁকাচ্ছেন আট লাখ টাকা। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত উঠেছে। ওয়ালীউল্লাহ বলেন, লকডাউনের প্রভাবে স্থানীয় সব হাটবাজার বন্ধ। তাই এটিকে হাটে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে লোকমুখে খবর পেয়ে ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে বেশ কয়েকজন ক্রেতা আমার বাড়িতে এসে ষাঁড়টিকে দেখে গেছেন। তবে এখনও উপযুক্ত দর বলেনি কেউই। আশানুরূপ দাম পেলে তবেই এটিকে যোগ্য ক্রেতার হাতে তুলে দেবো। তবে ন্যায্য দাম না পেলে এটিকে আগামী বছরের জন্য রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়ালীউল্লাহর। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী বছর রাজপুত্রকে চট্টগ্রামের কোরবানির পশুর হাটে নিয়ে বিক্রি করবেন বলেও জানান তিনি।স্থানীয় কৃষক ও গরু বিক্রেতা মনতোষ ত্রিপুরা জানান, বাজারে হাজারের বেশি গরু-ছাগল উঠেছে। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। তিনি সাতটি গরু এনেছেন। চারটি ৬০-৬৫হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছেন। যেগুলো বিক্রি করেছেন সেগুলোর ওজন ১১০-১২০কেজি ছিল। যে তিনটি বিক্রি করতে পারেননি, সেগুলো ১৪০-১৫০কেজি ওজনের। ৭৫-৮০হাজার টাকা হলে বিক্রি করবেন।

গরু বিক্রেতা বারেক মিয়া জানান, হাটে দুটি গরু এনেছেন তিনি। এক লাখ টাকা করে দাম চাচ্ছেন। কিন্তু ক্রেতারা ৮০হাজারের বেশি দাম বলছেন না। এই দামে বিক্রি করলে লোকসান হবে তার। বাজারে ক্রেতা নেই, বাইরের ক্রেতারাও আসতে পারেননি। তাই দাম কম।

গরু ব্যবসায়ী নুরু মিয়া জানান, তার ১০টি গরুর একটিও বিক্রি করতে পারেননি। আগে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরের ব্যবসায়ীরা গরু কিনতে আসতেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে এবার তারা আসতে পারেননি। স্থানীয় ক্রেতাও খুব বেশি নেই।

হাটের ইজারাদার মো: জামাল উদ্দিন বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৭০-৮০টির মতো গরু-ছাগল বিক্রি হয়েছে। লকডাউনের কারণে ক্রেতা নেই। হাটের ইজারায় লোকসান গুনতে হবে।

মাটিরাঙা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা পলাশ কান্তি চাকমা বলেন, রাজপুত্রের চেয়ে বড় ষাঁড় এ জেলায় আর নেই। খুব যত্ন করে ষাঁড়টিকে বড় করেছেন ওয়ালীউল্লাহ। আমরাও সবসময় পরামর্শ দিয়ে তার পাশে ছিলাম। আশা করছি, তিনি এটিকে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারবেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নুরুল আফসার জানান, এ বছর জেলায় প্রায় ১২হাজার গরু, ছয় হাজার ছাগল কোরবানির জন্য প্রস্তুুতি করেছেন খামারিরা। লকডাউনে ক্রেতা সংকটে লোকসানের মুখে পড়তে পারেন তারা। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গেলো বছর এ জেলায় প্রায় ১১হাজার গবাদিপশু পালন করা হয়েছিলো। 

উল্লেখ্য, পার্বত্য জেলা পাহাড়ের প্রাকৃতিক সবুজ ঘাসে লালিত-পালিত দেশী-বিদেশী গরু কোরবানে চাহিদা থাকায় এ গো-খাতে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেন সাধারণ কৃষক ও গো-খামারীরা। গো-খামারে এবং গ্রামের পালিত গরুর নিয়মিত খাবারের তালিকায় প্রাকৃতিক সবুজ ঘাস, ভূষি, খৈল এবং খেড়। এসব খাবার সু-স্বাদু হওয়ার কারণে অল্প সময়ে গরু মোটাতাজায় পরিপুষ্ট হয়। ফলে এসব গরু কোরবানে বেশ চড়া দামে বিক্রি করে লাভবান হয় ব্যবসায়ীরা।