Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

আবু সাঈদ চৌধুরী : শ্রদ্ধাঞ্জলি জাতীয়

আবু সাঈদ চৌধুরী : শ্রদ্ধাঞ্জলি

কামাল বারি : মহৎ কর্মের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয় জীবনে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন- থাকবেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন দেশপ্রেমী কর্মবীর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থক উপাচার্য, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। স্বদেশ এবং বিদেশে বহুমুখী কর্মপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সৎ বিচারক, শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, রাষ্ট্রপতি, সংগঠক ও মননশীল সম্পাদক। সর্বপরি প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা অকুতোভয় একজন সেনানী। মুক্তিয্দ্ধু চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি। 

জন্ম ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে। পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী তদানীন্তন প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচিত স্পিকার ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৩৯ সালে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ এবং বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে লন্ডনের লিংকন্স ইন থেকে তিনি ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসায় যুক্ত হন। ১৯৬০-৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারপতি চৌধুরী ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে জেনেভা যান। এর মধ্যে ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র নিহত হয়। উপাচার্য হিসাবে তাঁর করণীয় সম্পর্কে যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান আবু সাঈদ চৌধুরী খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পত্র দিলেন- ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালনার পর আমার আর ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’

এ-অবস্থায় জেনেভাস্থ জাতিসংঘ প্রাসাদে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ভেনিজুয়েলার বিশিষ্ট কূটনীতিবিদ এগিলারের অনুমতি নিয়ে সভার শুরুতেই বিবিসির খবরের কথা উল্লেখ করে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমি অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। আমি এখনই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আজকেই লন্ডনে ফিরে যাব এবং সেখান থেকে সম্ভব হলে ঢাকায়। বর্তমান অধিবেশনের সমাপ্তি পর্যন্ত থাকতে পারছি না।’

স্বভাবগতভাবে আবু সাঈদ চৌধুরী নিরীহ ও শান্তিকামী ছিলেন। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়দীপ্ত একজন বীর বাঙালি। 

লন্ডনে ফিরে আবু সাঈদ চৌধুরী খুব দ্রুত কর্তব্য ও করণীয় স্থির করে ফেললেন। লন্ডনে ঘাঁটি করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে তিনি মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ২৩ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। এর পর ২৭ আগস্ট লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করে তিনি তাঁর পুরো অভিযানকেই একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামোয় রূপ দেন। তিনি একাধারে যুক্তরাজ্যের নানা দলমতে বিভক্ত বাঙালিদের একতাবদ্ধ করেছিলেন। অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদেরও একতাবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরূপে তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, পশ্চিম জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে গিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে জনমত গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের পুরস্কার স্বরূপ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে শপথ বাক্য পাঠ করান।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ‘ডক্টর-অব-ল’ ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনের কথা লিখে গেছেন ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। তাঁর ওপর আরও কিছু বই-পুস্তক রচিত হয়েছে। ২০২১ সালে জন্মশতবর্ষে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর প্রকাশিত হয়েছে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ নামে একখানি উপন্যাস। বোধ করি স্বাধীনতা আন্দোলনের এই কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বের ওপর আরও বই-পুস্তক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি সৃষ্টি হবে। ১৯২১ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মহান এই ব্যক্তিত্বকে জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট আবু সাঈদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।

কামাল বারি : কবি ও সাংবাদিক