Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

নড়াইলে অধ্যক্ষ ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় গ্রেফতার ৩ নড়াইল

নড়াইলে অধ্যক্ষ ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় গ্রেফতার ৩

নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ছাত্র রাহুল দেব রায়’র ধর্মীয় উস্কানির ফেসবুক স্ট্যাটাস’র বিষয়কে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত (জুতার মালা দেয়া) করা, শিক্ষক শ্যামল ঘোষকে মারপিট এবং মোটরসাইকেল ভাংচুর ও পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদি হয়ে সোমবার (২৭ জুন) প্রায় ২শ জন অজ্ঞাত আসামী দিয়ে নড়াইল সদর থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত ৩ যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার (২৭ জুন) রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন নড়াইল সদরের বিছালী ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের মালেক মুন্সীর ছেলে বখাটে শাওন মুন্সী, মির্জাপুর গ্রামের সৈয়দ মিলন এর ছেলে সৈয়দ রিমন এবং একই গ্রামের মনিরুল শেখ। পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের পৃথক পৃথক স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে।

সূত্রে জানা যায়, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন ফেসবুকে ভারতের নুপুর শর্মা’র ছবি দিয়ে “প্রনাম নিও বস নুপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম ” ক্যাপশন দেয়। ১৮ জুন সকালে তাকে কলেজে দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাস তাৎক্ষনিক বিষয়টি উপস্থিত শিক্ষকদের জানান। এরপর স্থানীয় মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন, কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তী, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নড়াইল-১ আসনের সাংসদ কবিরুল হক মুক্তি সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানান। 

মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিন কলেজে থেকে রাহুলকে নিয়ে যেতে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারমুখি হয়ে উঠেন এবং বাঁধা দেন। কিছু সময়ের মধ্যে নড়াইল সদর থানার ওসি শওকত কবির অতিরিক্ত ফোর্স নিয়ে সেখানে পৌঁছান। রাহুলকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলাম আরোও পুলিশ নিয়ে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে যান। সাধারণ শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের বুঝিয়ে রাহুলকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। আস্তে আস্তে লোকজন বাড়তে থাকে আর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আরোও অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় সেখানে যান। রাহুলের উপযুক্ত বিচার দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ওই এলাকার সাধারণ জনগন ও শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাহুল রায়কে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। 

নড়াইলের পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় পরিস্থিতি শান্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় লোকজন যোগ দেয়ায় পুলিশের সাথে জনগনের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এমনকি ৬ রাউন্ড টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। এ সময় কলেজ চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কয়েকজন পুলিশ, কলেজ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ আহত হন। কলেজ’র বাংলা বিষয়ের শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে বাথরুমে আটকে রাখে। বিক্ষুব্ধরা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাস, শিক্ষক প্রশান্ত রায় ও শিক্ষক অরুন কুমার মন্ডলের মোটরসাইকেল ভাংচুর করে পুড়িয়ে দেয়। সকাল ১১ টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তান্ডব চলে। বিকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলে যান। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার দু’জন মিলে উপযুক্ত বিচার দেয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে রাহুলকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। উদ্ধারের সময় ওই কুচক্রীদের উস্কানিতে একদল যুবক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে মারপিট করেন।

ছাত্র রাহুলের বিরূদ্ধে আন্দোলন চলাকালে একটি কুচক্রী মহল তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরূদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে আন্দোলন ঘনিভুত করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক লোক বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরূদ্ধে ছাত্র ও এলাকার লোকজন ক্ষেপায় তোলেন ওই কুচক্রী মহল। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র চেয়ার দখল করার জন্য অনেক আগে থেকেই চক্রটি নানা ধরনের কুট কৌশল করে আসছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র চেয়ার ও কলেজ’র ৫টি পদে কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে সক্রিয় থাকা ওই চক্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র বিরূদ্ধে সুকৌশলে অপপ্রচার করে সাধারণ মানুষদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’র চেয়ার দখল করে ৫জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সুযোগ বুঝে নিরাপরাধ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরূদ্ধে উস্কানী দিয়ে ছাত্র ও সাধারণ জনগন ক্ষিপ্ত করে তোলে। ইতোপূর্বে  এ চক্র নানা ভাবে কলেজে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও শান্তি নষ্ট করেছে। এ চক্রের নেতা রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে কলেজ সহ অত্র এলাকা অশান্ত করে তুলেছে। কলেজ ও রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মত একাধিক ঘটনা ঘটালেও ওই খলনায়ক সব সময় ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে। 

এদিকে, ১৯ জুন সকালে নড়াইল-১ আসনের সাংসদ কবিরুল হক মুক্তি কলেজে গিয়ে শান্তি সভা করেন। সভায় কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন কুমার চক্রবর্তী অনাকাংখিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। সেই সাথে কলেজের শিক্ষকদের মোটরসাইকেল ভাংচুর করা ও পোড়ানো, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ও মারপিটের ঘটনায় কোন মামলা করবেন না বলে ঘোষনা দেন। শান্তি সভা শুরুর পূর্ব মুহুর্তে কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে “অচিনের দুই গালে জুতো মারো তালে তালে” শ্লোগান হয়। শান্তি সভায় বক্তব্যে এলাকার ফয়সাল হোসেন কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর অপসারন দাবি করেন।  সাংসদ কবিরুল হক মুক্তি সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতী বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করেন। উপস্থিত  সকলে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ২১ জুন কলেজের ৭ জন শিক্ষক কলেজের জিবি’র সভাপতি অচিন চক্রবর্তীর সাথে দেখা করতে গিয়ে তাদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেন। এ সময় তিনি তাদের বলেন মারাত্মক রক্তাক্ত আহত শ্যামল কুমার বিশ্বাস (বাংলা) ও অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিকট হতে এক মাসের ছুটির আবেদন এনে দাও তারা ছুটিতে থাকুক। সেই সাথে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিকট হতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদের পদত্যাগ পত্র এনে দিতে বলেন।

এদিকে ১৮ জুন দীর্ঘ সময় ধরে কলেজে তান্ডব চালানোর খন্ড চিত্র ও বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সর্বমহলে সমালোচনার ঝড় উঠে। অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত)কে লাঞ্ছিতের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি উঠে। অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কে লাঞ্ছিতের সাথে জড়িতদের কেউ কেউ রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় থেকে গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টায় আছেন। 

 ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। অহেতুক তার বিরূদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতী বিনষ্ট করা হচ্ছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। এলাকার সচেতন মহল মুসলমান ধর্মের উপর আঘাতকারি রাহুলের বিচার দাবি করেছেন। সেই সাথে উস্কানী দিয়ে কলেজ এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া ও নাশকতার সাথে জড়িত সকল অপরাধির গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেছেন। 

পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেন, তদন্ত চলছে। প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। আসামী ২জন গ্রেফতার হয়েছে। অন্যান্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।