Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

বেদনায় ঘণ্টা কাঁদে! মতামত

বেদনায় ঘণ্টা কাঁদে!

সৈয়দা রুখসানা জামান শানু : বিদ্রোহী কবি কবিতা লিখে বিদ্রোহ করেছেন, নারীরা তাঁদের শ্রমঘণ্টার জন্য প্রতিবাদ করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ৮মার্চ বিশ্বব্যাপী নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। খেলা-ধুলা, পিকনিক, উৎসব, পূজা-পার্বণ, প্রতিযোগীতা সবই জীবনের এক অপরিহার্য্য চাহিদা। বর্তমান সময়ে পরিবেশ অনুকুলে না থাকা সত্তেও নানা দিবস ছোট করে হলেও পালিত হচ্ছে। জনগন দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিষয়কে অনুধাবন করে ছুঁতে পারছেন।

নানা পন্ডিতবর্গের কথায় বলা যায়, আলো ছড়াতে আর আঁধার তাড়াতে সৃজনশীল পাঠের কোনো বিকল্প নেই। তাই জন্ম হতে বেড়ে উঠায় মানুষের জীবনে সভ্যতার বিকাশ ঘটে শিক্ষা সংস্কৃতির সম্মিলনে। আর এই শিক্ষা সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটাতে শিক্ষালয় বা বিদ্যালয়ের বিকল্প কিছু দেখিনা। জ্ঞান অর্জনের বাহক বই আর সম্মিলন ঘটানোর বাহক বিদ্যালয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে জ্ঞানার্জন, বিজ্ঞান চর্চা, সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় পরিভ্রমনের জন্য যে অধ্যয়ন প্রয়োজন সেটাতো বিদ্যালয়ের পক্ষেই সম্ভব। বিদ্যালয় নিত্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ইতিহাস-ঐতিহ্য শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকতো ছাত্র-ছাত্রী। সেই ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ নিত্য স্কুল গিয়ে বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞানের সাগর পাড়ি দিতে না পারে তবে আমাদের সমাজ বির্ণিমানে এ প্রজন্ম দূরে থেকে যাবে। অধ্যয়ন ছাড়া বিশ্বকে চেনা-জানা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জ্ঞানার্জনের জন্য বিদ্যালয়ের সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের এক নিবিড় সর্ম্পক বিদ্যমান।

সকালের সোনা ঝরা সোনালী আকাশে মেঘেদের দল নানা আল্পনায় কখনও বা পাল তোলা নৌকো হয়ে ভেসে বেড়ায়। তেমনি সকাল হলেই শত শত, হাজার হাজার হাসি নিয়ে বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী প্রবেশ করে। আহা কি আনন্দ সেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। কত ছোটা ছুটি, এর ওর সাথে গল্প, খেলাধুলা, এরই মধ্যে এ্যাসেম্বেলি’র ঢংঢং ঢংঢং ঢংঢং ঢংঢং করে ঘণ্টা বেজে ওঠল। আহা! কী ডিসিপ্লিং সারিবদ্ধভাবে ছাত্র-ছাত্রী লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো। ঝলমলে সকালে চলল পিটি, প্যারেড, মার্চপাস্ট, জাতীয় পতাকার প্রতি স্যালুট, জাতীয় সংগীত। এরপর যার যার শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ। প্রতি সকালে শিক্ষার্থী আর শিক্ষকগণের এমন আদর্শিক মিলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অধ্যয়ন ও পাঠদান।

একটি বিষয়ের ওপর পাঠদান শেষে হলে একটি ঘণ্টা বেজে ওঠে। এভাবে কোনো বিদ্যালয়ে তিনটি বিষয় পাঠদান শেষে আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে চারটি বিষয় পাঠদান শেষ হলে আনন্দের ঘণ্টা বেজে ওঠে। আনন্দের ঘণ্টা অর্থাৎ টিফিনের বেল বেজে ওঠে। এই টিফিনের ঘণ্টা শুনে শির্ক্ষাথীগণ মহানন্দে হৈচৈ করে শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে, হুড়াহুড়ি করে স্কুলমাঠে খেলার জন্য জমায়েত হয়। টিফিনের এই ঘণ্টার শব্দের সাথে অদ্ভূত এক মায়া জড়ানো আবেশ থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের। যেন মনে হয় গোলাপী আভায় স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ রাঙিয়ে চলেছে। এই দেখে শিক্ষকগণের ক্লান্তি শোধিত হয়ে যায়।

প্রতিদিন শিক্ষকগন একই নিয়মে স্কুলে আসেন। কিন্তু আসেনা তাঁদের প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীগণ। ছন্দহীন শ্রেণিকক্ষের শূন্যতা আর স্কুল ক্যম্পাসে নীরবতার বিলাপ দেখে দিনকাটে। তাঁদের চোখে নিত্য ভাসে প্রিয় শিক্ষার্থীর চোখ, মুখ, উইনিফর্ম। নাকে ঘ্রাণ আসে স্বর্ণচাঁপার মিষ্টি গন্ধ। আর কানে বাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শৈশব কৈশরের দূরন্তপনা শব্দের সাথে পাঠ লেন দেন। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকগণ দেখতে পাচ্ছেন এক অজানা আশংকা। যেখানে দীর্ঘ ২৪ মাসে ঘণ্টা’র বেদনার সুর কান্নায় ভাসছে। যেখানে বিন্দু বিন্দু করে শিক্ষার আলো নিভে যাচ্ছে। বিদ্যাপিঠে বিমুখ হয়ে শিক্ষার্থীরা অন্ধকার খোলসে চলে যাচ্ছে। কত দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, কবি, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী তৈরি হওয়ার আর বিজয়ের পঞ্চাশ ও সুবর্ণ জয়ন্তী বোঝার আগে চোরা বালিতে পা পিছলে ডুবে যাচ্ছে। শব্দের রেসের মাঠ, অবিরাম শব্দের আশ্চর্য প্রাণ স্পন্দন, কত চ্যালেঞ্জ, কত অর্জন এবং কত সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হতে চলেছে। ডিজিটাল ক্লাসরুম কীভাবে উচ্ছ্বাস-আনন্দ চিত্তে ছুটে এসে পাঠ দেয়া এবং নেয়া করতে পারে? তারপর রয়েছে প্রান্তিক ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে বিস্তর ডিজিটাল বৈষম্য। চিরবাস্তব এ বেদনার ভার শিক্ষগণকেই বহন করতে হচ্ছে।
 
এদিকে শিক্ষার্থীগণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকালের ঘড়ির কাঁটার দিকে। চিরাচরিত নীতিতে সেকেন্ডের কাঁটা চলছে ডানদিকে। কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা হয়, রাত হয় আবার সকাল হয়। ১২ ঘণ্টা পর পর তিন কাঁটা মিলিত হয় অথচ কোমলমতিদের স্কুলের কাঁটা অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকমন্ডলী এবং স্কুল ঘণ্টা কবে যে নিয়মিত মিলিত হবে? চিরচেনা শ্রেণি কক্ষ, সহপাঠি, খেলার মাঠ আরপরিচিত দৃশ্য কবে দেখতে পাবে? কভিড সময়ের আবরন থেকে কবে মুক্তি পাবে? কবে প্রিয় ক্লাসরুমে বসে ছুটির ঘণ্টা শুনতে পাবে? কবে আর কতদিনে ডানা মেলে প্রভাত ফেরিতে আর স্টেডিয়ামের ডিসপ্লেতে অংশগ্রহণ করতে পারবে? এমন সব কত কথা কোমল মস্তিস্কে কড়া নাড়ছে বার বার। তাদের এ প্রশ্নের উত্তর কেউ কী আছে দেবার?

জনগন দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিষয়কে অনুধাবন করে ছুঁতে পারছেন। কিন্তু আদৌ কী সম্ভব কোমলমতিদের ডিজিটাল ক্লাস রুমের মাধ্যমে এসব আনন্দ ছোঁয়ার? জানিনা করোনা নামক ব্যাধি কত দিনে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে, আনন্দ-হৃদয় জাগানিয়া বিদ্যালয় হতে চিরতরে বিদায় নেবে?

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, সংগঠক, সম্পাদক-প্রকাশক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কবি।

 

এই বিভাগের অন্যান্য খবর