Opu Hasnat

আজ ২৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ২০২৪,

যৌনপল্লীর শিশু, যৌনকর্মী, বেদে ও হিজড়াদের নিয়ে ডিআইজি হাবিবের পরিকল্পনা রাজবাড়ী

যৌনপল্লীর শিশু, যৌনকর্মী, বেদে ও হিজড়াদের নিয়ে ডিআইজি হাবিবের পরিকল্পনা

দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যা এখন দৌতদিয়া পূর্ব পাড়া নামে পরিচিত। এখানে বসবাস করে রক্তমাংসে গড়া একদল মানুষ। রয়েছে ১ হাজার ৩ শত যৌনকর্মী ও তাদের পরিবারের ৩ শতাধীক শিশু। ছোট বেলা থেকে মায়ের পেশা দেখে দেখে বড় হয় তারা । মায়ের পেশা দেখে মা ও সমাজের প্রতি ঘৃনা তৈরি হয় তাদের। এক পর্যায়ে অপকর্মে জরিয়ে পরে এসব শিশুরা।

এবার যৌন কর্মীর সন্তানদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা ও তাদের সমাজের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করছে উত্তরন ফাউন্ডেশন। যার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ হাবিবুর রহমান পিপিএম (বার) বিপিএম (বার)। 

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লী, বেদে, হিজড়াসহ পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে উত্তরন ফাউন্ডেশন ও ডিআইজি মোঃ হাবিবুর রহমানের পরিকল্পনা নিয়ে একান্ত স্বাক্ষাতকারে তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি পেশারই স্বাধীনতা আছে। দৌলতদিয়া পূর্ব পাড়ার বাসিন্দারা যৌনকর্ম করে শরীর খাটিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য অর্থ আয় করে। সেই অর্থে একদল সুযোগ সন্ধানী এতদিন ভাগ বসিয়ে আসছিলো। ওদের প্রতি নির্যাতন করে ভয়ভীতি দেখিয়ে পদদলিত করে রেখেছিলো। কেউ যাতে তাদের আয়ের অর্থ ছিনিয়ে না নিতে পারে সে জন্য পুলিশ নজর রাখছে। একজন মানুষের ১৮ বছর পূর্ন হলে সে নিয়মের মধ্যে থেকে এই পেশায় নাম লেখাতে পারবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ যাতে এই পেশায় না আসে এবং কাউকে ফাদে ফেলে জোর করে এই পেশায় না রাখে সেজন্যও আমাদের নজরদারি আছে। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর কাজ করার অনুপোযোগিরা অন্য পেশায় যেতে চাইলে তাদের প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করা হবে।

করেনা কালীন এই সময়ে দৌলতদিয়া যৌনপল্লী পূর্বপাড়ার বাসিন্দারা লকডাউন মেনেছে। তাদের সাহায্য সহযোগিতা সম্পর্কে ডিআইজি বলেন, করোনা সময়ে সমাজের দরিদ্র মানুষেরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে। ধার দেনা করে হলেও চলতে পেরেছে। কিন্তুু ওরা সমাজ থেকে আলাদা ওদের সাথে কারো ব্যাক্তিগত সম্পর্ক ও সামাজিক সম্পর্ক নাই। যে কারনে তাদের পাশে দারিয়েছে উত্তরন ফাউন্ডেশন। গত পাচ মাসে ছয়বার খাদ্য সহায়তা, ঈদুল ফিতরে খাদ্য সামগ্রী ও কাপড়, ঈদুল আযহায় তাদের সকলের এক সাথে মাংস খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে উত্তরন ফাউন্ডেশন। 

যৌনপল্লীর শিশু ও তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ডিআইজি হাবিব বলেন, যৌনপল্লীর শিশুদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা ও তাদের সমাজের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে উত্তরন ফাউন্ডেশন। তিনি বলেন প্রতিটি শিশু বড়দের অনুকরন করে। মায়ের পেশা দেখা বড় হওয়া এসব শিশুরা মা ও সমাজের প্রতি ঘৃনা করতে শিখে। শেষে মেয়ে শিশুা মায়ের পেশায় ফিরে যায় আর ছেলে শিশুরা পথভ্রষ্ট হয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত হয়। আমরা যৌনপল্লীর এসব শিশুদের বাহিরে রেখে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করে সমাজের একটা অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যাতে মা ও মাতৃভুমি এবং সমাজের প্রতি তাদের সম্মান বাড়ে। 

মৃত্যুর পরে যৌনকর্মীর শেষ অধিকার জানাযা সম্পর্কে হাবিবুর রহমান বলেন, অতি পুরাতন এই পেশায় তারা এতটাই অবহেলিত যে মৃত্যুর পরে একটি মানুষ তার জানাযা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মানুষের পাপ পূন্যের বিচারের মালিক সৃষ্টি কর্তা। একজন লোক ডাকাতি করে, মানুষকে হত্যা করে, এমন কি ? পতিতা পল্লীতে সারারাত অপকর্ম করে মারা গেলে তার স্বজনরা ঘটা করে তার জানাযা করে কিন্তুু পেটের দায়ে যে যৌন কর্ম করে তার জানাযা করা হবে না এটা কেমন কথা? এটা তার সামাজিক ও মানবিক অধিকার আমরা সেই দৃষ্টিকোন থেকে জানাযা প্রথা চালু করেছি। এটা ধরে রাখার দায়িত্ব সমাজের। সমাজের সচেতন মানুষগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বেদে ও হিজড়াসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির জীবনমান সম্পর্কে উত্তরন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, পিছিয়ে পড়া অবহেলিত এসব জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে উত্তরন ফাউন্ডেশন সারাদেশে বেশ কয়েকটি ডেইরি ফার্ম, বিউটি পার্লার, বুটিক হাউজ, মিনি গার্মেন্টস, টেইলার্স স্থাপন করে দিয়েছে।  

তিনি হিজড়াদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে বলেন, তারা জ্ঞানে, দক্ষতায় এবং মেধা-মননে মূল ধারার জনগোষ্ঠীর থেকে কোন অংশেই কম নয়। শুধুমাত্র শারীরীক গঠনের কারণে আজ তাদেরকে পরিবার ও সমাজ আর দশ জনের মত মেনে নিতে পারছে না। হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্যগণ সমাজের জন্য বোঝা নয়। তারা কারো না কারো ঘরেরই সন্তান। তাদের বাবা-মায়েরাও আমাদের মত করেই সন্তানের একটি উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে তারা আজ তাদের নিজের সন্তান থেকে দূরে থাকছেন। আমাদের মত একই রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে হিজড়ারা নানান সামাজিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, যেমন- তাদেরকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না, যানবাহনে চড়তে গেলে বাধা দেওয়া হয়, হাটে-বাজারে তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করা হয়, এমনটি চিকিৎসার সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এসব নানাবিধ কারণে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেকের মধ্যে দৃষ্টিকটু আচরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ আমাদের একটু ভালবাসা ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবই তাদের একটি সুন্দর ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিতে পারে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর অর্জিত সফলতা যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। 

সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে ডিআইজি বলেন, ২০১৩ সালে রাষ্ট্র তাদেরকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করেছে, পাশাপাশি সরকার এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বেশকিছু কার্যক্রমও হাতে নিয়েছেন। কিছুদিন আগে আমরা লক্ষ করেছি যে, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদেরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুকে টেনে নিয়েছেন। সরকারের এই মহতি মনোভাবকে তিনি হিজড়াদের ভাগ্য পরিবর্তনের ইতিবাচক দিক হিসেবে মনে করেন এবং  উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে অবহেলিত নারীদের নিয়ে কাজ করে অসহায় নারী ঐক্য সংগঠন। সংগঠনটি সভানেত্রী ঝুমুর বেগম বলেন, আমরা বাংলাদেশ পুলিশের তিনজন কর্মকর্তা পেয়েছি। তারা হলেন, ডিআইজি হাবিবুর রহমান, এসপি মিজানুর রহমান ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আশিকুর রহমান। এই তিন রহমানের তদারকিতে আমাদের হাসি ফুটেজে। এখন মনে হচ্ছে আমরাও মানুষ। আমাদেরও বেচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার আমাদের ওই তিন কর্মকর্তা দিয়েছে। 

গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আশিকুর রহমান পিপিএম বলেন, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশ পুলিশের আইজি স্যার, ডিআইজি স্যারের নির্দেশে মানবিক পুলিশিং কার্যক্রম করছি। আমাদের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার যৌনপল্লীর বাসিন্দা ও তাদের শিশুদের নিয়ে যে কাজ শুরু করেছেন তা নির্দিধায় একটি মহৎ কাজ। আমরা স্যারের এই মহৎ কাজকে স্যালুট জানাই।

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম বলেন, দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের উপর আর কেউ যাতে অমানুষিক নির্যাতন চালাতে না পারে সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর আছে। এই এলাকার সব ধরনের অপরাধ বন্ধ করা হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সব সময় তাদের খোজ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি করোনা কালীন সময়ে তাদের একাধীক বার খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও যৌনপল্লীর শিশুদের জীবনমান গঠনে উত্তরন ফাউন্ডেশন যে কাজ করছে এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সহযোগিতা করছে। তাছাড়াও দৌলতদিয়া যৌনপল্লী ও ঘাট এলাকায় আর কোন অপরাধী যাতে অপরাধমূলক কর্মকান্ড না করতে পারে সে ব্যাপারেও আমাদের নজর আছে।   

ডিআইজি হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালের ২২ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্র দিঘলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি মোল্লা পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে ১৭ তম বিসিএস এ এএসপি হিসেবে যোগদান করেন। বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী সারদা থেকে সুনামের সাথে প্রশিক্ষন শেষে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে ২০১৬ সালে যোগদান করেন। সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকার পুলিশ হেডকোয়ার্টার ফুলবাড়িয়া পারসোনাল মেনেজম্যান্ট শাখায় অতিরিক্ত ডিআইজির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করায় দুইবার পিপিএম ও দুইবার বিপিএম পদক লাভ করেছেন।