Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

‘অপরীক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর’ : আদিল মাহমুদ মতামত

‘অপরীক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর’ : আদিল মাহমুদ

বিকশিত পুঁজিবাদ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মানুষ এখন ‘পণ্য’। আবার এই মানুষই কোথাও মানুষের নিয়ন্ত্রক। কিন্তু বিদ্বান কিংবা পন্ডিত হলেই তিনি যে ‘প্রকৃত মানুষ’ সেটা প্রমাণ হয়ে যায় না। কারণ, ‘প্রকৃত মানুষ’ বলা যত সহজ, হওয়াটা ততটাই কঠিন।

প্রকৃত মানুষের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলি, মানবতাবোধ এবং মানবাধিকার বিকশিত হয়। চরম সত্যকে দুই হাতে উঁচু করে, সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্তাল সাগরে ভেসে এগিয়ে যান তিনি, এগিয়ে নেন সমাজকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন বিশ্বাস, আস্থা অর্জনই প্রকৃত মানুষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি পথ খোঁজেন পথে পথে। ‘বিপদে-আনন্দে’, ‘অন্যের প্রয়োজনে’ নিজের খেয়েই তিনি পরের ঘরে আলো জ্বেলে পথ হাতড়ান। ‘দুঃখ-সুখের উত্তাল সমুদ্র’ হাতড়ে তিনি তাকে দাঁড় করাতে সক্ষম হন সংগ্রামের পাহাড় চূড়ায়, ঠাঁই করে নেন ইতিহাসে।
 
আগামী দিনের নতুন সূর্যের সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত হয় তার মন। আনন্দ ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরা থাকে তার প্রতিটি মুহূর্ত। কিন্তু এই ‘প্রকৃত মানুষ’ কে, তিনি কোথায়?  

এখন সমাজে মানুষ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক সবসময় সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের বৈষয়িক চিন্তায় মগ্ন থেকে অন্যের সুখ-দুঃখ তার কাছে ভাববার বিষয় হয়ে ওঠে না। এ স্বার্থান্বেষী চিন্তাধারা এখন মানুষকে মানুষের প্রকৃত রূপ থেকে ক্রমেই আলাদা করে দিচ্ছে। কি পরিতাপ!

ভালোবাসা-শ্রদ্ধা আজ হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লুণ্ঠন ও পাপকর্মের কাছে পরাজিত। এমনই কি হওয়ার কথা ছিল? বিশ্ব বিবেক জেগে ওঠো। জাগাও এবং জাগাও ঘুমন্ত ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা আর আন্তরিকতা। কপটতা আর স্বার্থপরতা সুদূরে মিলাক।  

গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। এই সংজ্ঞাটি আজও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে সৃষ্টির আলোকে চিন্তা করলে এর সত্যতা পাওয়া বড়ই মুশকিল। মানুষ-মনুজ, মনুষ্য, আদম, আদমি, ইনসান, মানব, মানুখ, লোক, হোমো ইত্যাদি নামে পরিচিত। কিন্তু ‘প্রকৃত মানুষ’ কে?

অ্যারিস্টটল বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের সঙ্গে মানুষের তুলনা করেছেন। তাহলে কি যার বুদ্ধি নেই, মস্তিষ্ক বিকৃত তিনি কি স্রষ্টার সৃষ্টি রক্তে মাংশে গড়া মানুষ নয়! যার বুদ্ধি আছে বা বেশি-ই আছে সে-ই কি শুধু মানুষ? যেমন, আবার বিজ্ঞানী যিনি পারমানবিক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি তৈরি করেন তারাই শুধু মানুষ! না।  

বিশ্বজুড়ে আজ করোনা মহামারি হঠাৎ পরিবর্তিত জীবনে সচেতনতা ও মানবিকতার মাঝে এক দ্বন্দ্ব ঢুকে গেছে। কখনো তা সূক্ষ্ণ কখনো তা বাস্তবতার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মানবিকতা বজায় রেখে সচেতন হওয়া আর অতি সচেতনতার নামে অমানবিক হওয়া দুটোই এখন মুখোমুখি।

কত মহামারি গেছে, যুদ্ধ গেছে এ দেশে। সবাই সবাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে, মরেছে। এই আমরা আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশীর মৃত্যু বা অসুখের খবর শুনলেই ছুটে যাই। হাসপাতালে স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। লাশবাহী গাড়ি, জানাজার মাঠে জায়গা পাওয়া যায় না। কেননা আমরা হচ্ছি সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহে ‘মরি বাঁচি একসাথে’ এই মন্ত্রব্রতে দীক্ষিত জাতি।

কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক দূরত্বের নামে যে অমানবিকতা হচ্ছে, এর পেছনে উৎকণ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে অজ্ঞানতা। জানতে হবে, সর্দি-কাশি মানেই করোনা রোগ নয়। আর তা যদি হয়েই থাকে, তবে তার উপসর্গ অনুযায়ী ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে আইসোলেশন বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

লাশের জানাজা বা দাফনে শরিক না হওয়ার তেমন যুক্তি নেই। করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে করোনা ছড়ায় বলে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বলা হয়, মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর্যন্ত মৃতদেহের নাক বা মুখের নিঃসরণ বা সিক্রেশনে এই ভাইরাস থাকতে পারে। তবে উপযুক্ত প্রটেকশন নিয়ে লাশ ধুলে বা দাফন করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম নামের প্রতিষ্ঠানের যেসব স্বেচ্ছাসেবী দল করোনা রোগীর লাশ বহন করা, জানাজা, দাফন ইত্যাদি করে আসছে; তারা কেউ এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়নি।
 
সামাজিক দূরত্ব মানে সম্পর্কের দূরত্ব নয়, বন্ধনের দূরত্ব নয়। দায়িত্ব বা ভালোবাসার দায় থেকে সরে আসা নয়। বিশেষজ্ঞ কর্তৃক নিয়ম ও রাষ্ট্রনীতির ওপর আস্থা রেখে কয়েক দিনের জন্য সহনশীল হতে হবে সবাইকে। নির্ধারিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সবার পাশে থাকতে হবে। ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। চলুন ঘরে থেকে সুস্বাস্থ্য, সৃজনশীল এবং মানবিকতার চর্চা করি।

সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরীক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর’ অর্থাৎ জীবনকে বা মানুষকে অবশ্যই পরীক্ষিত হতে হবে। ‘প্রকৃত মানুষ’ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আগে নিজেকে অন্যের কল্যাণে সঁপে দিতে হবে। সৌন্দর্য, বেশভূষা, শিক্ষা, দীক্ষা, ক্ষমতা, দক্ষতা সব আছে কিন্তু নিজেকে ‘প্রকৃত মানুষ’ রূপে ভাবতে না পারাটা তার মুখাবয়বই জানান দেয় ‘ভেতরের পোড়া কষ্ট’।  

পরিশেষে কবিতায় বলতে চাই-
মানুষের মানে কি দুপুরের পোড়া রোদে শুধুই হেঁটে চলা
রোদঝরা ফ্যাকাসে বিকেলের ক্লান্তিহারা ক্রন্দন
নাকি জুতোর নিচে পিচের আলিঙ্গন
জীবনের সাথে মনের মিলনের মিথ্যে আয়োজন
নাকি চোখে জল নিয়ে জালানার গ্রীল ধরে লুকিয়ে থাকা?
 
লেখক : পরিদর্শক (তদন্ত), পরশুরাম থানা, ফেনী।

এই বিভাগের অন্যান্য খবর