Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

নড়াইলের গন্ডব গ্রামে ভাংচুর-লুটপাটের মহোৎসব চলছে নড়াইল

নড়াইলের গন্ডব গ্রামে ভাংচুর-লুটপাটের মহোৎসব চলছে

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার গন্ডব গ্রামে ট্রিপল মার্ডারকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাংচুর-লুটপাট চলছেই। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হত্যা পরবর্তী ভাংচুর-লুটপাট, নারী নির্যাতন, মামলা এ যেন নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব ঘটছে লোহাগড়া উপজেলার কাশিপুর ইউপির গন্ডব গ্রামে। প্রায় এক দশক ধরে গ্রাম্য কোন্দলের কারণে চলছে সংঘাত আর হানাহানি। এতে করে ধ্বংস হচ্ছে বাড়িঘর আর লুটপাট হচ্ছে মানুষের সহায় সম্বল। প্রতিপক্ষের অব্যাহত হামলা ও মামলার ভয়ে এই গ্রামের পুরুষ সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে গ্রামটি হয়ে পড়েছে পুরুষশূন্য। এ ছাড়াও সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হচ্ছে, অব্যাহত হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এ সব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গ্রাম ছেড়ে পাশ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর ভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। 

সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে লোহাগড়ার দাঙ্গা কবলিত কাশিপুর ইউনিয়নের গন্ডব গ্রাম ঘুরে আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি আরোও জানান, অধিকাংশ বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ নেই। পুরুষশূন্য গন্ডব গ্রামে ওহিদুল ইসলামের বাড়ি। বসত ঘরের দরজা-জানালা ও বেড়া ভাঙ্গা। শূন্য পড়ে আছে গোয়ালঘর। মুঠোফোনে কথা হয় তার স্ত্রী রহিমা খাতুনের (২৫) সাথে। 

তিনি জানালেন, ‘গত ১০ জুন গ্রামে মারামারি হবার পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রতিপক্ষের অন্তত ৬০-৭০ জন লোক দেশীয় অস্ত্র রামদা, সড়কি ছ্যান’দা নিয়ে বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে বেধড়ক মারপিট করে সোনাদানা, টাকা-পয়সা, মূল্যবান আসবাবপত্রসহ গোয়াল ঘরে থাকা তিনটি গর্ভবতী গাভীসহ মোট ৭টি গরু ও ১১টি ছাগল লুট করে নিয়ে যায়। এরপর তিনি সব কিছু ফেলে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া দু’টি সন্তান মুগ্ধ ও স্মিগ্ধকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন যশোর জেলার মনিরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। একই রকম ঘটনা ঘটেছে পাশের আজাদ বিশ্বাসসহ প্রায় শতাধিক বাড়িতে। এ সব বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর-লুটপাট করা হয়েছে। ঘরের জানালা-দরজা ও ঘরের চালের টিন খুলে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। 

আজাদ বিশ্বাসের স্ত্রী পারুল বেগম (৩৮) মুঠোফোনে জানান, হামলার ভয়ে তিল তিল করে গড়া সংসার ফেলে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনটি সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নড়াইল সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। 

তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছেন, তার ৪টি গরু ও ৬টি ছাগলসহ বাড়ির সব কিছুই লুটেরা নিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, গ্রাম থেকে প্রায় শতাধিক টিউবয়েল, সেচের স্যালো মেশিন ও সেচ মোটর লুট করে নিয়ে গেছে। লুটেরা পাইপের মধ্যে ইট-পাথরের টুকরা ফেলে নষ্ট করে রেখে গেছে। লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনার পর খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, গ্রাম্য কোন্দলের কারনে গন্ডব-চালিঘাট গ্রামের অন্তত ২০-৩০ জন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাদের পড়া-লেখা বন্ধ করে মামলা-হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মামলায় জেল-হাজতে রয়েছেন। পালিয়ে বেড়ানো কয়েকজনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এরা সবাই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী, কয়েকজন আবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে গন্ডব গ্রামের বুলবুল কাজীর ছেলে নয়ন কাজী ও আজাদ বিশ্বাসের ছেলে আজিম বিশ্বাস, তারা লোহাগড়া সরকারী কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। লোহাগড়া কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী চালিঘাট গ্রামের রউফ মোল্যার ছেলে বাবু মোল্যা জেল-হাজতে রয়েছেন। একদিকে প্রতিপক্ষের হামলা, অন্যদিকে মামলার ভয়। অপর দিকে লোহাগড়া সরকারী পাইলট স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা, মরিচপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতি খানম, রসো খানমসহ অনেকের অন্য সবার মতো তাদেরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার কথা থাকলেও সম্ভ্রম হারাবার ভয়ে লোখাপড়া ও টিউটর বাদ দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা সেখানে ঘুমিয়ে দিন-রাত পার করছেন। শুধু তাই নয় মারপিটের ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছে। 

তাদের সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলে জানা গেছে, হামলা আর পুলিশের অজ্ঞাত ধারার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে। আতঙ্কে আছে লোহাগড়া সরকারী কলেজের এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিম বিশ্বাস। সে জানায়, প্রতিনিয়ত হামলা, লুটপাট-ভাংচুর আর হুমকির ভয়ে সে বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে মামলা হবার কারণে পুলিশের ভয়ে বাইরে বের হতেও পারছে না। কলেজ, পড়ালেখা, প্রাইভেট টিউটর সব বাদ দিয়ে অন্যদের মতো সেও এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীরা করছে মানবেতর জীবনযাপন। এখানেই শেষ নয় গ্রাম্য কোন্দলের কারণে মামলা থেকে বাদ পড়েনি ঢাকায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, সরকারী-বেসরকারী চাকুরিজীবিসহ স্থানীয় সাংবাদিক। গন্ডব গ্রামের গোলাম রব্বানী শেখের ছেলে রফিকুল ইসলাম ও ইউনুচ শেখের ছেলে জাকিয়া মাহমুদ ঢাকা জগন্নাথ কলেজ ৩য় বর্ষ, আশরাফুল ইসলামের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এমবিএ শেষ বর্ষ, হিরু শেখের ছেলে সবুজ শেখ ঢাকা কলেজ ইকোনোমিক্স অনার্স ২য় বর্ষ, আমীর শেখের ছেলে বিপুল শেখ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ৩য় বর্ষ, জিল্লু শেখের ছেলে রিয়াজ শেখ তেজগাও পলিটেকনিক্যাল কলেজ কম্পিউটার সায়েন্স ৩য় বর্ষ ও রশিদ মীনার ছেলে বায়েজিদ মীনা যশোর এমএম কলেজ ইংলিশ মাষ্টার্স ২য় বর্ষ। ফরিদপুর রাজেন্দ্র সরকারী কলেজের প্রভাষক বিসিএস (শিক্ষা) সালাহউদ্দিন রাজু, নড়াইলে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত তরিকুল ইসলাম, ঢাকার বেসরকারী সংস্থায় চাকুরিজীবি মৃত আকতার শেখের ছেলে ফরিদ শেখ, রউফ শেখের ছেলে নাজির শেখ, মৃত সরোয়ার শেখের ছেলে ফারদুল্লাহ শেখ ও চালিঘাট গ্রামের শুকুর মোল্যার ছেলে আনিচ মোল্যা, লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার কল্যাণ সহকারী রুমানা ইসলাম ও লোহাগড়া প্রেসক্লাবের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক এবং দৈনিক মানবজমিনের লোহাগড়া উপজেলা প্রতিনিধি শাহজাহান সাজু। 

কাশিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল ইসলাম বলেন, চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও ভিজিডি-ভিজিএফ’র চাল চুরির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশ করার কারনে দুদকে মতিয়ারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বাদী তার পক্ষীয় লোক হওয়ার সুবাদে সুযোগবুঝে সাংবাদিক সাজুর মামলায় দেওয়া হয়েছে। সাজুর বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দুরে পৌর শহরের গোপীনাথপুর গ্রামে। গন্ডগোলের সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত শিক্ষার্থী ও চাকুরিজীবি ও সাংবাদিকের নামে মামলা দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানিয়ে মামলা থেকে অব্যহতি প্রদানের অনুরোধ করেছেন এই প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা। 

অজ্ঞাত নামা আসামীর ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুঠোফোনে এলাকার কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতেই এসব হামলা, ভাংচুর আর লুটপাটের মহোৎসব চলছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে এসব ভাংচুর ও লুটপাট চলছে। 

মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে কথা হয় ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসের মানিক মিয়ার সাথে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এতোবড় লুটপাট-ভাংচুর ও মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি করে নাই। পুলিশের উপস্থিতিতে স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরের মধ্যে এটা রেকর্ড। সমরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। শেষ বয়সে এসে এটা দেখতে হলো ! মানুষ ভয় আর লজ্জায় মুখ খুলতে পারছে না।’ ঘটনার পর থেকে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

এ ব্যাপারে লোহাগড়া থানার ওসি সৈয়দ আশিকুর রহমান লুটপাটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গত কয়েক দিন পুলিশ শুধু রাতে প্রহরা দেয়। বড় গ্রাম, পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে দু’একটি বাড়িতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। অভিযোগ পেলে এসব বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

উল্লেখ্য, উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের গন্ডব-চালিঘাট গ্রামে আধিপত্য বিস্তর নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে গ্রাম্য কোন্দল চলছে। এর একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নড়াইল জেলা পরিষদ সদস্য শেখ সুলতান মাহমুদ বিপ্লব। অন্য পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন মিরাজ মোল্যা। এর জের ধরে গত ১০ জুন দুপুরে গ্রাম্য দাঙ্গায় গন্ডব গ্রামের মোকতার মোল্যা, হাবিল মোল্যা ও চালিঘাট গ্রামের রফিক শেখ খুন হয়। এ ঘটনায় লোহাগড়া থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। দুটি মামলাই তদন্তনাধীন রয়েছে।