Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

কুষ্টিয়ার ৪ বীরমাতার কথা... মুক্তিবার্তাকুষ্টিয়াবিশেষ সংবাদ

কুষ্টিয়ার ৪ বীরমাতার কথা...

বীরঙ্গনা শব্দটির সমার্থক অর্থ যাই হোক, বীরমাতা বলেই সম্বোধন করবো মহান এ নারীদের। বাঙ্গালী নর-নারীর যে বীরত্বে সমান পারদশী তার জলন্ত উদাহরন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমাদের বীরঙ্গনা বীরমাতাদের অবদানে আমরা চির ঋণী। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারী। যেসব নারীরা আজো সামাজিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। সমাজের কাছ থেকে পেয়েছে শুধুই ঘৃনা, বঞ্চনা। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন সরকার তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ দেশ স্বাধীনের পেছনে তাদের রয়েছে অসামান্য অবদান। ১৯৭৫ সালে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কেমন ছিলো বঙ্গবন্ধুর সন্তানতুল্য এ দেশের বীরঙ্গনারা। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে খালী হাতেই বিদায় নেই অনেক বীরমাতারা। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছিলো তারা। সমাজের চোখে তারা ছিলো ভিন্ন। এমনকি অনেকেরই ঠাই ছিলো না তার নিজের স্বামীর কাছে। 

তবে দীর্ঘ ৪৩ বছর পর সেই বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি মিলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থাপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বিরঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বীরঙ্গনার পরিচয় পাল্টে তার এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই পরিচয়টি পেতেই ছিলো তাদের লম্বা প্রতিক্ষা। তাদের এ প্রতিক্ষার পালার অবসন ঘটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের দিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। সেই সৌভাগ্যবান বীরাঙ্গনাদের ৪ জন কুষ্টিয়ার এলেজান, দুলজান, মোমেনা, মজিরন। 

যারা কিনা দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতে গোলাম আযমদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আজ তাদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ¡াস। চোখে আনন্দ অশ্রæ। স্বামী সন্তানদের গর্বের শেষ নেই। সরকারী গেজেট প্রকাশের পর ওই সদ্য সনদ পাওয়া ওই বীর সেনানীদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জানা গেল।

এলেজান :
কুষ্টিয়ার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর উত্তরপাড়া গ্রামে এলেজান নেছা’র বাড়ী। বয়স সত্তর ছুই ছুই। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে সমাজ তাকে দিয়েছে বঞ্চনা, ঘৃনা। লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অভাব অনটনের সাথে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। শরীরের নানান রোগ শোকে বাসা বেঁধেছে। জীবনের শেষ সময়ে একটু সম্মানের অপেক্ষায়। কিন্তু সেই অপেক্ষার পালা কবে শেষ হবে? এমন প্রশ্নের অবসান হয়েছে ক’দিন আগেই। যেদিন সরকার তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেমন লাগছে জানতে চাইলে চোখের জল যেন ঠেকানো যাচ্ছিলনা। তবে এই জল কষ্টের নয়, আনন্দের। দীর্ঘ ৪৩ বছর পর স্বীকৃতি পাওয়ায় তাই জমিয়ে রাখা পানি ধরে রাখতে পারেননি তিনি। আল্ল¬াহর কাছে হাজার শুকরিয়া জীবনের শেষ সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ায়। আল্ল¬াহ শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখুক। 

এলেজান জানান, স্বামী সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। পেটের পীড়া, কান দিয়ে অঝরে পানি পড়ে। নানা রোগ শোকে বাসা বেঁধেছে। নিরাময় হচ্ছেনা। স্বামীর হাই প্রেসার। তাঁর শরীরও ভাল নেই। অভাবের তাড়নায় ছেলের লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। সহায় সম্বল বলতে কিছু নেই। অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করি। অসবর সময়ে বাড়তি রোজগারে তাঁতের কাজ করি। এতসব কষ্টের দিনে জীবনের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আমাকে দারুনভাবে গৌরবান্বিত করেছে। আজ আমার পরিবারে কোন অভাব থাকবেনা, সমাজে দুষ্টুচক্ররা কোন খারাপ কথা বলবেনা। আমি আজ মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের শেষ দিনগুলো গৌরবের সাথে পার করতে পারব। স্ত্রীর এমন স্বীকৃতিতে দারুন খুশি স্বামী আকবর আলী। 
আকবর আলী জানান, মুক্তিযোদ্ধার স্বামী হিসেবে দারুন লাগছে। আমার স্ত্রী সম্পর্কে আর কেউ বাজে কথা বলবেনা। স্ত্রীর এমন স্বীকৃতিতে স্বামী হিসেবে গর্বিত। আর মায়ের এমন স্বীকৃতিতে কম খুশি নয় ছেলে তরিকুল। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এখন থেকে পরিচিত হব একি কম আনন্দের?

দুলজান :
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে খুঁশির অন্তনেই একই এলাকার দুলজান নেছারও। স্বামীহারা অভাবের সংসারে সরকারের এমন স্বীকৃতি কি কম আনন্দের? স্বামী হারা দুলজানের এমন কষ্টের দিনে এমন সুসংবাদ আসবে ভাবতেও পারেননি কখনো। তবে দুখের পরে সুখ আসে এমন প্রবাদের কথা জানা ছিল তাঁর। আর এর প্রমাণও মিলেছে জীবনের শেষ মুহুর্তে।

দুলজান নেছা জানান, আমার তো কোন অন্যায় বা পাপ ছিল না, ছিলনা কোন অপরাধ। একটিই অপরাধ ছিল আমার, আমি এই বাংলার মাটিতে জন্মেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দালালদের সাহায্যে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন ও সম্ভ্রম হানি করেছিল হিংস্র জানোয়ারের মতই।

আমি মনে করেছিলাম দেশে আমার পরিচয় মনে হয় আর কোনদিন হবে না। তবে অনেক বছর পরে হলেও হয়েছে। এখন আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমারও রয়েছে এ দেশের মধ্যে অধিকার। মৃত্যুর আগে এ সম্মান পাবো ভাবতেই পারিনি আমি।  এদিকে মায়ের এমন স্বীকৃতে খুঁশির অন্ত নেই সুমনা খাতুনের। 

সুমনা জানান, দীর্ঘদিন ধরে শুধু শুনেই আসছি যে আমার মায়ের তালিকা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখতে পায়নি। গেজেট প্রকাশের সংবাদে তিনি খুশি, তবে এর কোনই মুল্য নেই আমার কাছে। কারন আমার মায়ের এই শেষ পর্যায়ের সাংসারিক জীবনে দৈন্যতা ঘোচাতে কোন কাজেই আসছে না। আমি সরকারের কাছে পূনর্বাসনের আবেদন করছি।

তবুও হাসিনা সরকার আমার মাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি। এখন মুক্তিযোদ্ধা মায়ের সন্তান একটি দারুন অনুভূতি।

মোমেনা :
পাশের গ্রাম বানিয়া কান্দির আরেক বিরাঙ্গনা মোমেনা খাতুন। তিনি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তাঁর কন্ঠেও একই উচ্চারণ। 

মোমেনা খাতুন জানান, আমি ভাবতেও পারিনি যে মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পরে আমরা এ সম্মান পাবো। মুক্তিযুদ্ধের সে দিনের কথা এখনো আমার মনে কষ্টের ঝড় তোলে। সেদিনের কথা ভেবে এখনো আমার গা শিউরে উঠে। যুদ্ধের পরে কতো বছর কেটে গেলো, আমাদের মতো মানুষের খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিলো না। মাঝে মাঝে মনে হতো আমি কি দেশের জন্য কিছ্ইু করিনি? সারাটি জীবন আক্ষেপ নিয়ে থাকতে হবে ভেবেছিলাম। তবে জীবনের শেষ সময় যে এমন স্বীকৃতি পাবো ভাবতেও পারিনি কখনো। কিন্তু এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। আমি একটা সম্মান পেয়েছি। আমিও মুক্তিযোদ্ধা। আল্লাহর প্রতি লাখো শুকরিয়া। আল্লাহ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখুন।

প্রমত্ত পদ্মার পাড় ভাঙ্গা ধ্বংলীলার মতোই ৭১’র মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হিংস্রতার গ্রাসে দুমরে মুচরে দিয়েছিল না ফোটা কুঁড়ি পদ্মা পাড়ের মাত্র ১৪ বছরের কিশোরী আজকের বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মোমেনা খাতুন।

মজিরন :
একই উপজেলার মধুপুরের মজিরন নেছারও কি কম উচ্ছ¡াস। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে পরিবারে বইছে আনন্দের বন্যা।

দীর্ঘ ৪০বছরের বয়ে চলা কলংকিত গøানী, অপমান ও লাঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান স্বীকৃতি পেয়ে অশ্রæজলে বুক ফাটা কান্নায় নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন মজিরন নেছা। 

তিনি জানান, অনেক অপমান, অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি। এখন আমরা একটা সম্মান পেয়েছি। জাতীয় ভাবে আমরা যুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেয়েছি। এর চেয়ে বেশি বিছু চাই না আমি। শেখ হাসিনা আমাদের যে সম্মান দিলো তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। 

কুষ্টিয়ার এই ৪ বিরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খূঁশি জেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু।

তিনি জানান, সব সরকারের কাছেই এই বীরাঙ্গনাদের যোগ্য মর্যাদার দাবীতে সকল মুক্তিযোদ্ধারা স্বোচ্চার ছিলেন। কিন্তু বিগত কোন সরকারই বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিয়ে যে অবদান রাখলেন তার ঋণ কখনো শোধ করার মত নয়।

দেরীতে হলেও সরকারের এমন স্বীকৃতিকে যুগান্তকারী হিসেবে দেখছেন ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটি। কমিটির নেতা অসিত সিংহ রায় ও এ্যাড. লালিম হক জানান, একমাত্র বর্তমান সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করে। বীরাঙ্গণাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এই সরকার আরেকবার প্রমান করল একমাত্র শেখ হাসিনার সরকারই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার।