Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

বাবা দিবসেই মুছে গেল স্মৃতিময়ের স্মৃতি, ছুটি না পাওয়ায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী’র মৃত্যু খাগড়াছড়ি

বাবা দিবসেই মুছে গেল স্মৃতিময়ের স্মৃতি, ছুটি না পাওয়ায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী’র মৃত্যু

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বাবা দিবসের সকালে চেংগী নদীর পাঁচ মিশালী মাছ উপহার দিয়েই বাবাকে সারপ্রাইজ দেয়ার স্বপ্ন ছিলো ছেলের। তাই পাশের বাড়ির শান্ত, রুপাস ও বিপ্লবসহ মাছ ধরার সিদ্ধান্ত নেয় তৎময় চাকমা (২২)। অবশেষে রোববার (২১ জুন) দিবাগত রাত ১২টায় মাছ ধরার মিশনে নেমে চোরাবালিতে তলিয়ে গেলেই সব স্বপ্ন শেষ।

পানছড়ি উপজেলার অক্ষয় মেম্বার পাড়া গ্রামের স্মৃতিময় চাকমা ও অনুজা চাকমার এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়েই সাজানো সংসার। মেয়ে বড় এরই মাঝে বিয়ে হয়েছে। ছেলে তৎময় সংসারের একমাত্র মধ্যমনি। মা-বাবার স্বপ্ন ছেলে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী করে সংসারের হাসি ফোটাবে।

তাইতো ছেলের প্রতি আলাদা যত্ন আর মায়াভরা আদর। এরি মাঝে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়ে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। কিন্তু স্মৃতিময়ের স্বপ্ন পূরণের আগেই বাবা দিবসে না ফেরার দেশে পাড়ি জমাল তৎময়।

রোববার (২১ জুন) বেলা তখন দুইটা। শান্তিপুর রাবার ড্যাম এলাকায় চেংগী নদীর বালুর চরে দু’হাত মুঠিয়ে বসে ছেলের মরদেহের অপেক্ষায় বাবা। চোখ দুটো লাল, আর চোখের জলে মুখে দেয়া মাস্কটি ভিজে চপচপ। হাজার হাজার নারী-পুরুষের সমাগমে নিজ গ্রামবাসী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও ডুবুরি দলের দিকে তীক্ষদৃষ্টি কখন খুঁজে পেতে পারে আদরের ছেলেকে।

সন্ধা ৭টার আগেই ব্যর্থ মিশন শেষ করে বিদায় নেয় ডুবুরির দল। হাল ছাড়েনি আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী। ২১জুন রোববার রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে অল্প পানিতে ভেসে উঠে মরদেহ। বাবা স্মৃতিময় তখন বাকরুদ্ধ। কাছে গিয়ে ছেলেকে এক নজর দেখার শক্তি যেন শেষ।

তৎময়ের মরদেহ নিয়ে সবাই বাড়ির পথ ধরেছে পা যেন চলছে না একমাত্র ছেলেহারা পিতা স্মৃতিময়ের। কয়েকজনে ধরে শক্তি দিচ্ছে আমরাতো আছি। নির্বাক পিতার মুখে কোন কথা নেই। একপা, দুপা করে হেলেধুলে এগিয়ে চলছে ছেলের পিছনে পিছনে গন্তব্য অক্ষয় মেম্বার পাড়া।

তৎময় চাকমার মামা বিদ্যালয় শিক্ষক নন্টু চাকমা জানান, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী মিলে মরদেহ পাওয়ার আশায় একটি জাল বাসানোর কাজে ব্যস্ত ছিল সবাই। অবশেষে রোববার (২১ জুন) রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে পাশেই অল্প পানিতে মরদেহটি ভেসে উঠে। তৎময় অক্ষয় মেম্বার পাড়া গ্রামের স্মৃতিময় চাকমা ও অনুজা চাকমার ছেলে।

উল্লেখ্য পানছড়িতে চেংগী নদীতে মাছ ধরতে এসে নিখোঁজ শিক্ষার্থী তৎময় চাকমা (২২) এর মরদেহ উদ্ধার হয়। এর আগে রাঙামাটির ডুবুরির একটি দল প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। শনিবার দিবাগত রাত আনুমানিক রাত ১২টার দিকে চার বন্ধু মেলে শান্তিপুর রাবার ড্যাম এলাকায় জাল দিয়ে মাছ ধরতে এসে সবার অজান্তে সে নিখোঁজ হয়। 

পানছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ মো: দুলাল হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

এদিকে খাগড়াছড়ির রামগড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও ) থেকে ছুটি না পাওয়ায় অসুস্থ অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেনি মাঠকর্মী নবরতন চাকমা। আর তার স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী করেছেন মানিকছড়ি এরিয়া ম্যানেজার ইকবাল বিন তৈয়বকে। শারীরিককভাবে দুবর্ল বাড়ীতে একা থাকা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য ২দিন ছুটি চাইলেও ছুটি দেয়নি এরিয়া ম্যানেজার। অসুস্থাতার বিষয়টি জানানোর পরও মন গলেনি ম্যানেজারের। পরে অসুস্থতা নিয়ে মৃত্যু হয় মাঠকর্মী নব রতন চাকমা স্ত্রী বিপাশী চাকমার।

মাঠ কর্মী নবরতন চাকমা জানান, ‘রামগড়ে পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন সংস্থার মাঠকর্মী হিসেবে আট মাসে যোগ দিই। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সোমবার আমাকে প্রশাসনিক কারণে রামগড় থেকে মানিকছড়িতে বদলি করা হয়। আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রামগড় ভাড়া বাসায় রেখে মানিকছড়িতে যোগ দিই। যোগদানের পর অসুস্থ স্ত্রী আমাকে ফোন করে তার অসুস্থতার কথা জানায়। স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য আমি একাধিকবার ম্যানেজারের কাছে ছুটি চাই । স্ত্রী অসুস্থ জেনেও তিনি আমাকে ছুটি দেয়নি। ছুটি না পাওয়ায় বাড়ি যেতে পারেনি।

তিনি আরো জানান, ‘বুধবার আমার স্ত্রী গুরতর অসুস্থ হোন। এসময় সহকর্মীরা আমাকে দ্রুত রামগড় হাসপাতালে আসতে বলে। তখনও জানতাম না আমরা স্ত্রী মারা গেছে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম আমার স্ত্রী মারা গেছে। তার সাথে শেষ দেখাও হয়নি, কোন কথা বলার সুযোগও পায়নি।

নবরতন চাকমা এ প্রতিবেদককে আরো জানান, ‘ম্যানেজার আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানার পর ছুটি দেয়নি। আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা রামগড়ের বাঞ্চ ম্যানেজার এরিয়া ম্যানেজারকে ফোনে জানালে তিনি বাঞ্চ ম্যানেজারকে ‘গালিগালাজ’ করে। উনার কারণে আমার স্ত্রী মারা গেছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এটি স্যারকে বারবার বলার পরও তিনি আমাকে ছুটি দেয়নি। স্ত্রীর পাশে থাকলে তার কখনো মৃত্যু হত না। আমি ম্যানেজারের শাস্তি চাই।’’

বিষয়টি নিয়ে মাঠকর্মী নবরতন চাকমা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগঘন পোস্ট দেওয়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠে। এমন অমানবিক কর্মকান্ডের জন্য এরিয়া ম্যানেজারকে দুষছেন সবাই। করোনার মতো মহামারীর সময়েও এমন অমানবিক কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান অনেকে।

বিপাশী চাকমার মৃত্যুর জন্য এরিয়া ম্যানেজারকে দায়ী করে বিচার দাবি করেছে স্বজনরা। তারা বলেন, এরিয়া ম্যানেজারের গাফিলতি কারণে বিপাশী চাকমার মৃত্যু হয়। তার গর্ভের সন্তানও মারা যায়। এরকম যাতে আর কারো ক্ষেত্রে না ঘটে। আমরা এর বিচার চাই।

তবে এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র মানিকছড়ি এরিয়া ম্যানেজার ইবকাল বিন তৈয়ব। এই নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ঐ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘পদক্ষেপের একজন কর্মী হয়ে নব রতন চাকমা এভাবে ফেসবুকে লিখতে পারে না। তার অভিযোগ মিথ্যা। তিনি আমার কাছে সেভাবে ছুটি চাননি। তার স্ত্রী স্টোক করে মারা গেছে। তিনি (নব রতন চাকমা) সেখানে থাকলেও মারা যেত আর না থাকলেও মারা যেতনা এটি ঠিক নয়।