Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

প্রাপ্তির উপযুক্ত সময় : মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার মতামত

প্রাপ্তির উপযুক্ত সময় : মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

একটি সাধারণ বিকেলের ঘটনা। মামদু গাসামা নামের এক ব্যক্তি উত্তর  ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের এক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রু মার্কস-ডর্ময় রাস্তায় ঢুকেই তিনি সেখানে প্রচণ্ড ভিড় দেখে থমকে দাঁড়ালেন। সবাই তাকিয়ে আছে একটি ফ্ল্যাটবাড়ির উপরের দিকে। সেখানে পাঁচ তলার ব্যালকনিতে ঝুলে আছে একটি শিশু। আর পাশের বাড়ির ভেতর থেকে প্রতিবেশীরা ছেলেটিকে টেনে ভিতরে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

গাসামা পরে বলেছিলেন, চিন্তা করার মতো কোন সময় তার কাছে ছিল না। তরতর করে এক কার্নিশ থেকে আরেক কার্নিশ বেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। নীচ থেকে দর্শকরা চিৎকার করে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ‘এগিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি করো।’

এদিকে ছেলেটি যে হাত দিয়ে ব্যালকনি ধরে ঝুলেছিলো তার জোর কমে আসছিলো। কিন্তু সে পড়ে যাবার আগেই গাসামা গিয়ে হাজির হন পাঁচ তলার ব্যালকনিতে। এক হাত দিয়ে বাচ্চাটিকে ধরে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ব্যালকনির ভিতরে। ওই ঘটনার পর সাহসী ওই তরুণকে ‘১৮ শতকের স্পাইডার ম্যান’ খেতাব দিয়েছেন। দেশের সব নাগরিকের জন্য ওই তরুণকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি।

তিনি যখন ছেলেটিকে নিরাপদে তুলে আনছিলেন, তখন নীচের লোকজন করতালি দিচ্ছিলেন, আনন্দে শীষ দিচ্ছিলেন, মোবাইল ফোনে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা বিশ্বে। এই অসীম সাহসিকতার জন্য ২২ বছর বয়সী মামদু গাসামার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

এক পর্যায়ে জানা গেলো মামদু গাসামা হলো মালি থেকে আসা একজন অবৈধ অভিবাসী, তখন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাকে বীরত্বের জন্য একটি পদক দেন। এরপর তিনি ঘোষণা করেন যে, গাসামাকে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। প্যারিসের মেয়রও তাকে পদক দেন। শহরের দমকল বিভাগ তাকে চাকরির জন্য ইন্টার্নশিপ দেয়।

এ ঘটনার পর বছর জুড়ে মামদু গাসামা বেশ কয়েকবার সংবাদমাধ্যমের সামনে আসেন। গত জুন মাসে লস অ্যাঞ্জেলসে ব্ল্যাক এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ডে মানবিকতার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়। লাজুক স্বভাবের গাসামা খুব কম কথা বলেন। তার একজন বন্ধু বলছিলেন, সংবাদমাধ্যমের নজর তার ওপর পড়ার পর তিনি একটু ঘাবড়েই গেছেন।

কিন্তু প্যারিসের দমকল বিভাগে খণ্ডকালীন চাকরি শুরুর একদিন আগে তিনি লে প্যারিসিয়েন সংবাদপত্রকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। এতে সে দিনের সেই ঐতিহাসিক উদ্ধার অভিযান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কত তলার ওপরে উঠছি, আমি সেটা নিয়ে মোটেই ভাবছিলাম না। নিজের বিপদেরও কথাও আমার মাথায় ছিল না।’

ঐ উদ্ধার অভিযানের দু’সপ্তাহ পর গাসামা মালির প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে নিজ দেশে ফিরে যান। রাজধানী বামাকোতে ২০১১ সালের পর প্রথমবারের মতো গাসামা, তার বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা একসঙ্গে মিলিত হন। মালি থেকে গাসামা যখন ভাগ্যান্বেষণে উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পৌঁছান তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। আর তার বাবাও এতোদিন পর তাকে দেখার জন্য গ্রাম থেকে প্রথমবারের মতো রাজধানী বামাকোতে আসেন।

বলা হচ্ছে গাসামা খুব ভালভাবেই তার চাকরি করছে। তবে ১০ মাসের চুক্তি শেষ হবার পর তার ভাগ্যে কী  রয়েছে, সে সম্পর্কে এখনই কোন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তার ইন্টার্নশিপে ৯৬ ঘণ্টা কাজ করে গাসামা এখন পাচ্ছেন ৫৩৪ ডলার।

বাচ্চাটিকে উদ্ধারের সময় সবাই ধারণা করেছিল যে লোকটি পাশের ফ্ল্যাট থেকে শিশুটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল সে বাবা। কিন্তু পরে জানা গেল, না ছেলেটির বাবা তখন ঘরেই ছিলেন না। তিনি শিশুটিকে একা বাসায় রেখে শিশুটির বাজার করতে বেরিয়েছিলেন।
আর তার মা  ওই সময় বাড়িতে ছিলেন না। তিনি ফরাসি দ্বীপ রি-ইউনিয়নে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাবা হিসেবে দায়িত্বে অবহেলার জন্য গত সেপ্টেম্বর মাসে ঐ শিশুর বাবা আদালতে অপরাধী প্রমাণিত হন। তবে তার কিংবা তার সন্তানের পরিচয় কোন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।

ঐ নাটকীয় উদ্ধার অভিযানের মামদু গাসামা এখন আর প্যারিসের পূর্বাঞ্চলে তার ফ্ল্যাটে থাকেন না। নাগরিকত্ব ও বৈধ কাগজপত্র পাবার পর তিনি সরে গেছেন শহরের কেন্দ্রস্থলে যেখানে তিনি নিজের জন্য একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন।

গাসামার মতো আমাদের আশপাশেই আছে বহু তরুণ-তরুণী। কিন্তু তারা তাদের সক্রিয়তা ও সক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য যতোটা সহযোগিতা প্রয়োজন তা সময় মতো পায় না। কেউ কেউ হয়তো জীবনের অন্তিম সময়ে এসে রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পায়। আবার কেউ মরণত্তোর পুরষ্কারও পায়। আর তরুণদের সক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে সামান্য সহযোগিতা বরাদ্দ থাকে তা পৌঁছে দেবার জন্যও ব্যবহার করা হয় অনেক গুলো মাধ্যম। যা খুবই প্রয়োজনহীন।  যার কারণে ঐ সহযোগিতাও প্রার্থীদের হাত পর্যন্ত পৌঁছে না। ধিক্কার এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে, যেখানে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অনেকগুলো জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। শুধু ঝুঁকি অতিক্রম আর পরীক্ষায় পাশ করতে করতেই চলে যেতে হয় জীবনের অন্তিম একটি মূহুর্তে। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ের উৎসাহ আর পুরষ্কার গুলো আমাদের জন্য কতোটুকু প্রয়োজনীয়? পুরষ্কার, উৎসাহ, উদ্দীপনা আর সহযোগিতা পাবার উপযুক্ত সময় হলো যে কোন কাজ শুরু করার সময়টি।

লেখক- শিক্ষার্থী
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিভাগের অন্যান্য খবর