করোনা কালীন সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা মতামত / 
পুরো বিশ্ব আজ অদৃশ্য একশক্তি ও আতংকের রাজত্বে ঘরবন্দী যার নাম করোনা ভাইরাস (কোভিট -১৯)।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারী করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম সনাক্ত হয় ৮ ই মার্চ। সনাক্তের পর পরই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর আক্রান্তের সংখ্যা। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রতিদিন (সংবাদ বুলেটিনের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে) এখন পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ছুঁই ছুঁই মোট আক্রান্ত ষাট হাজার ছাড়িয়েছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও মোট মৃতের সংখ্যা হাজার এর দ্বারপ্রান্তে। সব মিলিয়ে এক নতুন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্ব। মানুষ একদিকে আতঙ্ক নিয়ে বাস করছে অন্য দিকে শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছে।এখন তাহলে আমাদের উপায় কী হবে? আমরা নিশ্চিত যে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের সব স্তরের অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী ঝরে পড়বে।
ইতিমধ্যে, মানুষের জীবন জীবিকার কথা চিন্তা করে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে সবকিছু সীমিত পরিসরে খুলে দিলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে এখন পর্যন্ত খুলে দেয়া হয়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলতে চাই না আমি, পরিস্থিতি অনুযায়ী এই বিষয়ে আমি পর্যায়ক্রমে ভাববো’। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত কে সাধুবাদ জানাই। তবে এ দীর্ঘ সময়টাতে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার উপর জোর দিতে হবে কেননা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথাই বলি তাহলে তারা এ সময়টাতে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস এর সাথে যুক্ত থাকতো, কিন্তু তারাও এখন মানসিক ভাবে অস্থিরতায় ভুগছে। তবুও মানুষ তো আশায় বাঁচে, কিছু আশা আমরা করতেই পারি। বিগত প্রতিটি অর্থনৈতিক মন্দার সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছিলো। এবারের মতো ভয়াবহ না হলেও কাছাকাছি। কাজেই আশা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যেই এই জাতীয় সমস্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো। প্রবাদে আছে, ‘প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক’, আজ বাংলাদেশ সহ পুরো বিশ্ব নতুন করে ভাবতে শিখছে। কিভাবে বৈশ্বিক মহামারী কাটিয়ে উঠা যায়।
মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীরা ফোন করে কিংবা ফেসবুকে জানতে চায়, কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে? কিংবা কবে নাগাদ খুলতে পারে, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে আছে কি না? আমি বুঝে যাই, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সঙ্গে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুধু নয়, আরও অনেক কিছু জড়িত। তাদের কয়েকজনের জীবন নিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রামের কথা জানি। তারা অনেকেই টিউশনি করে, কেউবা খণ্ডকালীন চাকরি করত। শুধু নিজেদের খরচই নয়, এই ক্ষুদ্র টিউশনির টাকা থেকে কেউবা মা-বাবার ওষুধের খরচ দিত, কেউবা হয়তো দিত ছোট ভাইবোনের পড়ার খরচ। করোনাকালে তার ভয় শুধু করোনা আক্রমণই নয়, আরও বিস্তৃত। করোনার থাবায় সে বেঁচে গেলেও কীভাবে লড়বে আবার বেঁচে থাকার জীবনে? মহামারী করোনা সবকিছুই যেন স্থবির করে দিল। আমার ব্যাক্তিগত মতামত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এ সময়টাতে তাদের মানসিক অস্থিরতা দূর করার জন্য এবং নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে পারে :
১. বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের যেহেতু একাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় তাই এই দীর্ঘ সময়টাতে তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস বা মহান ব্যাক্তিদের আত্মজীবনী পড়তে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাজেশন দিবো সবাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়ে ফেলো।
২. অবসর সময়ে সৃজনশীল কোন কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।
৩. যতটুকু সম্ভব ফেইসবুকে কম আসা, গুরুত্বপূর্ণ নিউজ দেখে বের হয়ে যাওয়া। যদিও শিক্ষার্থীদের জন্য এটা কষ্টসাধ্য কাজ তবুও চেষ্টা করা উচিৎ কারণ বেশিরভাগ সময় ফেইসবুকে থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ আসেনা, মানসিক অস্থিরতা আরো বাড়ে, সেই সাথে মাথা ব্যাথাসহ অন্যান্য স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. নিয়ম মাফিক খাবার, ঘুম এবং বয়স ও লিঙ্গ ভিত্তিক শারীরিক ব্যায়াম করা সেই সাথে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা।
৫. মানসিক প্রশান্তির জন্য কবিতা বা দৃশ্য অংকন কিংবা ভালো মুভি দেখা।
৬. যতটুকু সম্ভব বাবা মাকে বাসার কাজে সাহায্য করা।
আমাদের শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে যে জীবন গড়ায় সময়ে, পরিবার-সমাজ-দেশ ও সরকার কেবল পরিবেশ তৈরি করে দেয়। তাই এই দীর্ঘ সময়কে কাজে লাগাও। যে বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে রপ্ত করা সম্ভব হয়নি, এখন তা শিখে নাও। অখণ্ড অবসরে পছন্দের বিষয়গুলো আত্মস্থ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করো। আর শিক্ষার্থীদের বলবো, করোনার ভয় তো আছেই, তবু সময়টিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে জন্য বাড়তি পরিকল্পনা করো। নিজের নিরাপত্তা অটুট রেখে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর সময়ও এটি। নিজেকে শাণিত করা এবং নিজের মানবিক গুণাবলির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সময়ও হয়তো এখন। মনে রাখবে, অজস্র জীবন স্বপ্ন নিয়ে, অজস্র জীবনের পাশ দিয়েই তুমি হাঁটছো...।
শিক্ষার্থীদের আশেপাশে কেউ অভুক্ত বা অসহায় আছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। যে যেখানে আছো তোমরা তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্যের হাত টিকে বাড়িয়ে দাও। তবে আশার বাণী হচ্ছে, আমরা সবাই একদিন এই মহামারীর ছোবল থেকে রক্ষা পাবো। শিক্ষার্থীরা ফিরে যাবে শ্রেণিকক্ষে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ফিরে পাবে প্রাণ। শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষকরা কতটুকু অসহায় তা এই করোনাকালীন সময়ে একমাত্র শিক্ষকরাই বুঝতে পারছেন। ভালো থাকুক প্রিয় শিক্ষার্থীরা, ভালো থাকুক পুরো পৃথিবী।
কে.এম.সুজাউদ্দিন
সহকারী অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।