Opu Hasnat

আজ ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ২০২৪,

আনাহার-আর্ধাহার নিত্য সঙ্গী, সরকারদের খোঁজ নেয়না কেউ গাইবান্ধা

আনাহার-আর্ধাহার নিত্য সঙ্গী, সরকারদের খোঁজ নেয়না কেউ

এল.এন.শাহী, গাইবান্ধা থেকে : ঈদের দিনেও চুলোয় আগুন জ্বলেনি। এক ভাইকে দুপুরে খেতে দেয়া পতিবেশীর সেমাই আর অপর ভাইকে রাতে দেয়া আর এক প্রতিবেশীর আর অপর ভাইকে রাতে খেতে দেয়া আর এক প্রতিবেশীর ভাত এনে ভাগ করে খাওয়ার মতো চির অটুট ভালবাসায় যেন অলৌকিকত্ব জীবন-সংসারের আনাহার-আর্ধাহারকেই নিত্য সঙ্গী করে বেঁচে আছেন সরকার নামে পরিচিত ২ ভাই। 

জানা যায়, বাস্তভিটা না থাকায় গ্রামীণ পাকা সড়কে সাইব উদ্দিন ওরফে বড় সরকার (৬৫) ও তার মেঝো ভাই নাইব উদ্দিন ওরফে মেঝো সরকার। আর তাদের ছোট ভাই আলম মিয়া ওরফে ছোট সরকার খাদ্যাভাবে (অনাহারে) মারা যান। একই কারণ ছাড়াও চিকিৎসাহীনতায় বয়সের ভারে নূঁইয়ে পড়া সরকাররে মা জহিরন বেওয়া মারা গেছেন ৫ মাস আগে। তাদের দাফন হয়েছে প্রতিবেশী আঃ খালেক মন্ডল ও আলহাজ্ব কিশমত উল্ল্যাাহ্র পারিবারিক কবরস্থানে। কারণ, নিজেদের ভিটে মাটি না থাকায় মৃত্যুর পূর্বে মা জহিরন ও পুত্র আলম মিয়া ঐ ২ ব্যক্তির নিকট নিজ নিজ কবরের জন্য জায়গা চেয়েছিলেন। দিনের পর দিন অনাহার-অর্ধাহারের ফলে মা ও ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পর সরকার নামে পরিচিত নাইব উদ্দিন ও সাইব উদ্দিন নিজেদের কবরের জন্য ইতঃমধ্যে মানুষের দ্বারসস্থ হয়েছেন। একরকম আশ্বাস ও পেয়েছেন তাঁরা। 

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের পরাণ মৌজায় অবস্থিত ও বহুলালোচিত গণশার হাটের পাশে সুন্দরগঞ্জ ডিডব্লিউ সরকারী কলেজ মোড়-গনশার হাট-শোভাগঞ্জ ভায়া মাঠের হাট নামক গ্রামীণ পাকা সড়কে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে একটি ছোট্ট কুটিরে বাস করতেন ৩ ছেলেসহ মা জহিরন বেওয়া। নাইব, সাইব ও আলমের পিতা বাতাসু শেখ মাা যাবার পর যাদের জায়গায় আশ্রিত ছিলেন তাদরে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা জণিত কারণে জহিরান ও তার ৩ ছেলেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছেন। এসব জানিয়ে সাইব উদ্দিন ও নাইব উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ৬ মাস ধরে তাদের চুলোয় আগুন জ্বলেনা। সাইব উদ্দিন বর্গা নেয়া একটি ছাগলকে সারাদিন ঘাস খাওয়ান। আর নাইব উদ্দিন আশপাশের হাট বাজারের কসাইখানা থেকে জবাইকৃত পশুর (গরুর) হাড়-হাড্ডি কুড়িয়ে এনে মাস অন্তর বিক্রি করেন। তাতে মাসিক আয় হয় ৪’শ টাকা। আর গনশার হাটের ৪টি দোকান পাহাড়া দিয়ে পান দৈনিক ২০ টাকা। দোকান পাহাড়ার ২০ টাকায় ২ ভাই মিলে সকালে ও দুপুরে ২টি করে ৪টি পরটা খেয়ে থাকেন। এছাড়া, এই বাজারে বাজার করতে এসে যদি কেউ দয়া করে চিড়া বা মুড়ি কিনে দেন তাহলে রাতের খাওয়া হয় তাঁদের। অন্যথায় না খেয়েই রাত কাটাতে হয়। আর যদি ২ ভাইয়ের মধ্যে কেউ কোন ভাইকে বাড়ি ডেকে নিয়ে কিছু খেতে দেয় তা সেখোনে না খেয়ে আশ্রিত ঠিকানায় নিয়ে এসে ২ ভাই মিলে ভাগ করে খেয়ে থাকে তাঁরা। কেউ দায় করে কোন ভাইকে ১ কাপ চা খাওয়াতে চাইলে তা জিয়া রেখে অপর ভাইকে ডেকে এনে ভাগ করে খান (পান করেন)। সরকারদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কেউই কোন কাজে মজুরী চায় না। অলসতা নেই তাঁদের। কিন্তু কাজ নেই। নাইব ও সাইব উদ্দিন জানান, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি কেন যে কোন সময়ই তাদের ভাগ্যে ত্রাণ বা সাহায্য সহযোগিতা মেলে না। তাদের মা জহিরন বেওয়ার নামে একটি বয়স্ক ভাতা কার্ড ছিল। মা মারা যাবার পর ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সামিউল ইসলাম কার্ডটি নিয়ে গেছেন নাম বদলিয়ে সাইব উদ্দিনের নামে দেয়ার জন্য। তাছাড়া, এধরণের সহযোগিতা করার মত কেউই কোন দিন কোন প্রকার খোঁজ-খবর নেয়নি। তাঁদের আবাস কুটিরে কোন বিছানা পত্র, চৌকি বা খাট নেই। রাতে বাজারের ঐ ৪ দোকানের বারান্দায় থাকেন তারা। তবুও তাঁরা তাদের নিয়ে কোন দুঃখ প্রকাশ করেন না। কারো বিরুদ্ধে তাঁদের কোন অভিযোগ নেই। সদা-সর্বদাই হসোজ্জল মুখে কথা বলতে অভ্যস্থ।

প্রতিবেশী আবু সোলায়মান, সোহরাব হোসেন, ইউনুস আলী, ওমর আলীসহ অনেকেই জানান, খাওয়ার অভাবে অকালে আলম ও বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যু হয়েছে এদের। দুঃখ-দুর্দ্দশার কথা বলে শেষ করা যাবে না। ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি সুরুজিৎ কুমার প্রামানিক জানান, সাইব উদ্দিন ও নাইব উদ্দিনের নিজস্ব জায়গা-জমি না থাকায় রাস্তায় ঘর উঠানোর সময় আমরা তথা স্থানীয়ভাবে টিন, বাঁশ ও মিস্ত্রী খরচ বহন করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। 

ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সামিউল ইসলাম জানান, ইতঃপূর্বে ‘জমি আছে ঘর নাই’ পকল্পের আওতায় ঐ পরিবারকে একটি ঘর দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। তাদের জায়গা-জমি না থাকায় এ ইউনিয়নের (শান্তিরাম) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদসহ অনেক প্রচেষ্টা চালিয়ে ৪ শতক জায়গা নির্ধারণ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদেরকে এ ঘর দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর প্রতি বছর ঈদের আগে জহিরন বেওয়াকে ১টি শাড়ি ও ৫’শ টাকা করে ব্যক্তিগতভাবে দান করেছি। বয়স্ক ভাতা কার্ডটির নাম বদল করে মা জহিরানের বদলে বড় ছেলে সাইব উদ্দিনের নাম অন্তর্ভূক্ত করার প্রক্রিয়াধীন। তাঁদের দুঃখ-দুর্দ্দশার কথা জেনে খোঁজ-খবর রাখি।

উপজেলা ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে ৩’শ ৫ মেট্রিকটন চাল ও ১৮ লাখ ৫ হাজার টাকাসহ শিশু খাদ্যের জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। এছাড়া, করোনা ভাইরাস জনিত দূর্যোগে মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রমে ১০ হাজার ৫’শ নামের তালিকায় সাইব উদ্দিন ও নাইব উদ্দিনের নাম অন্তর্ভ‚ক্ত হয়নি বলে জানা গেছে।