Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

সমবায় সমিতির ওপর থেকে ১৫% আয়কর প্রত্যাহারের দাবি মতামত

সমবায় সমিতির ওপর থেকে ১৫% আয়কর প্রত্যাহারের দাবি

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। লোকসংখ্যার অনুপাতে এখনও আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক না হলেও সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটের সম্মুখীন। এই সংকট ক্রমশই বাড়ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ক্রেডিট ইউনিয়ন বা সমবায় প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণও এই সংকটের সম্মুখিন। আগামী দিনে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশংকা রয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাংলাদেশের সমবায় খাতও সংকটের সম্মুখীন। আগামী দিনে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশংকা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে এবং ১ লক্ষ ৭৭ হাজার নিবন্ধিত সমবায় সমিতি রয়েছে এবং প্রায় এক কোটির অধিক সমবায়ী রয়েছে। যারা কৃষি উৎপাদন, বিপণন, মৎস্য উৎপাদন, দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও সমবায় দুগ্ধ ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও নানা ধরনের কাজের সাথে জড়িত।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়কে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সংবিধানে ৩টি মালিকানা খাতের মধ্যে সমবায়কে ২য় মালিকানা খাত হিসেবে স্থান দিয়েছেন। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রকার সমবায় গড়ে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানাপ্রকার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সমবায়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সারা বিশ্বে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ বিপর্যয় রোধকরণ ও দুযোর্গ ব্যবস্থাপনায় অন্যতম পরীক্ষিত পদ্ধতি হিসেবে সমবায়কে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে ৭৭৭ কোটির অধিক জনসংখ্যা। জাতিসংঘের হিসাব মতে বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। বাংলাদেশে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না হওয়ায় সমবায়ীর সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।

দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ (কালব) সমগ্র বাংলাদেশে সমবায় অঙ্গনে ১০৪৮ টি ক্রেডিট ইউনিয়ন বা সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠন করে ১৯৭৯ সাল থেকে ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ, মূলধন প্রায় ৩৭০০ কোটি টাকা এবং কর্মী সংখ্যা ৩৬৬১ জন। কাল্ব-এর ৮৩২ জন কর্মী রয়েছে এবং মূলধন ৯০০ (নয়শত) কোটি টাকার অধিক। কাল্ব তার সদস্য ক্রেডিট ইউনিয়নের মাঝে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। বর্তমান মহামারী অবস্থায় সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সাধারণ ছুটি চলছে এবং সকল কার্যক্রম বন্ধ আছে। ফলে সমবায়ীদের সকল কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে বিনিয়োগকৃত ঋণের কিস্তি ও মুনাফা আদায়ও বন্ধ আছে। সদস্যদের আয় বন্ধ হওয়ায় সদস্যগণ আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিধায় ঋণের কিস্তি ও মুনাফা ফেরত প্রদানে অনীহা প্রকাশ করছে। ঋণের কিস্তি ও মুনাফা আদায় না হওয়ায় কালব বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ঋণ প্রদান করতে পারছে না। ফলে ক্রেডিট ইউনিয়নসহ কালব ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সমবায় সমিতির ওপর ১৫% আয়কর আরোপের ফলে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৪৭ ধারার উপধারা ১(ক),(খ),(গ)ও(ঘ) মোতাবেক যৌক্তিক কারণেই সমবায় সমিতির আয়ের ওপর কোনো কর আরোপিত ছিল না। কিন্তু ০৪/০৬/২০১৫ তারিখে তৎকালীন মাননীয় অর্থমন্ত্রী কর্তৃক জাতীয় সংসদে উত্থাপিত অর্থ বিল ২০১৫ এর ২২ নং অনুচ্ছেদে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৪৭ ধারার উপধারা ১ এর (ক) ও (গ) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে সমবায় সমিতিগুলোর আয়ের ওপর ১৫% হারে আয়কর আরোপ করা হয়। ফলে অন্যান্য সকল প্রকার সমবায়ীদের মতো ক্রেডিট ইউনিয়নের স্বল্প আয়ের সমবায়ীদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাজটি ব্যাহত হচ্ছে এবং ব্যাংক কভারেজের বাইরে থাকা সাধারণ স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের সঞ্চয় প্রবনতাকেও নিরুৎসাহিত করছে।

সমবায় সমিতিগুলোর ওপর এই কর আরোপ প্রত্যাহারের জন্য দেশে সমবায়ভিত্তিক ক্রেডিট ইউনিয়নসমূহের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ‘দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ (কালব)’ ২০১৫ সাল থেকেই দাবী জানিয়ে আসছে। বিগত বছর ঢাকা ও গাজীপুর জেলার বিশিষ্ট সমবায়ীদের নিয়ে নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মহোদয়ের উপস্থিতিতে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়-এর সাথে গোল টেবিল বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়- সমবায়ের ওপর বাড়তি বোঝা হিসেবে এই আয়কর প্রত্যাহার করে নেয়া হয়নি যা প্রকৃত সমবায়ীদের জন্য হতাশাব্যাঞ্জক।

মুনাফা অর্জন করাই সমবায় সমিতির মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং সদস্যদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গঠনই সমবায়ের মূল লক্ষ্য। আর তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণমুখি মানসম্মত সমবায় আন্দোলনকে দেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

সমবায় ক্রেডিট ইউনিয়নগুলো ন্যুনতম মুনাফায় নিজেদের সঞ্চিত তহবিল থেকে তাদের সদস্যদের মাঝে বিনিয়োগ করে থাকে। বিভিন্ন আমানতের মুনাফা প্রদান ও পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের পর যে স্বল্প মুনাফা অবশিষ্ট থাকে তা হতে সমবায় সমিতি আইন ২০০১ (সংশোধিত-২০১৩) এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত তহবিলে ১৫%, কু-ঋণ তহবিলে ১০%, সমবায় উন্নয়ন তহবিলে ৩% এবং উপ-আইনে অন্যান্য উদ্দেশ্যে ১০% পর্যন্ত সংরক্ষণ করার পর অবশিষ্ট মুনাফা সদস্যদের মধ্যে বন্টন করা হয়ে থাকে। ফলে ক্রেডিট ইউনিয়ন সমবায় প্রতিষ্ঠানে মুনাফা প্রদানের হার অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় খুবই কম। এ অবস্থায় সরকার কর্তৃক ১৫% আয়কর আরোপের ফলে সদস্যদের প্রাপ্ত মুনাফার হার আরো কমে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এখন সদস্যরা ক্ষুদ্র সঞ্চয় আর বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন এবং সমবায় আন্দোলন বিকশিত হতে পারছেনা, বরং তা আরো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

উল্লেখ্য যে, বিশ্বজুড়ে মহামারী করোনা ভাইরাসের গ্রাস থেকে আমাদের দেশও বাদ পড়েনি। দেশের অর্থনীতি আজ সংকটময় অবস্থায় বিপন্ন। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটের সম্মুখীন। এই সংকট ক্রমশই বাড়ছে এবং আগামী দিনে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ক্রেডিট ইউনিয়ন বা সমবায় প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণও এই সংকটের সম্মুখিন এবং সমবায় সমিতিসমূহ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

বর্তমানে দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় সমবায় খাতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সমবায়ের ওপর থেকে আরোপিত ১৫% আয়কর আগামী ২০২০-২০২১ অর্থ বাজেটে প্রত্যাহার করে নেয় সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়-এর নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক: আলফ্রেড রায়, সেক্রেটারি, কালব

এই বিভাগের অন্যান্য খবর