‘সামাজিক দূরত্ব’ যাদের পেশা এবং নেশা : মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার মতামত / 
সামাজিক দূরত্বই হলো মহামারি করোনাভাইরাসকে এড়িয়ে চলার সর্বোত্তম উপায়। যার সামাজিক দূরত্ব যত বেশি সে তত এ মহামারি থেকে বেঁচে থাকবে বলে ধারণা করা হয়। সুতারাং সারা পৃথিবীকে যখন করোনাভাইরাসের মহামারি গ্রাস করে নিয়েছে, তখন সামাজিক দূরত্ব একটি অমূল্য সম্পদ।
একদিন দুপুর বেলায় খুব ক্লান্তির পর রাজধানী ঢাকার একটি ব্যস্ততম চৌরাস্তায় দাঁড়াতেই একজন ভিক্ষুক এসে সামনে হাত পেতে রাখে। রোদে হাঁটতে হাঁটতে আমার চেহারা কালচে হয়ে গেছে। আর কপাল থেকে টুপ টুপ করে পড়ছে ঘাম। তখন এমনিতেই মেজাজ খুবই খিটখিটে তার মাঝে সামনে ভিক্ষুকের হাত। তারপরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করলাম। নিজের সাধ্যমতো সাহায্য কওে বিদায় কওে দিলাম ভিক্ষুককে। পরে অবশ্য ভিক্ষুককে অনুসরণ করতে লাগলাম। দেখলাম সে তার স্ব পেশায় বিরামহীনভাবে নিয়োজিত। সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর গ্লাসে আঙ্গুলের পিষ্ঠভাগ দিয়ে টুক টুক শব্দ করে ভেতরে থাকা লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই তার গাড়ির গ্লাস একটু নামিয়ে ভিক্ষুকের আকুতি শোনার চেষ্টা করেনা। আর ভিক্ষুকও তাদের নাগাল পায়না। এসব ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের মধ্যে রয়েছে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, এমপি, মন্ত্রী ও হাজার কোটি টাকার মালিকরা। যাদের গাড়ি, দালান ও হাজার কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের পেছনে আছে সহস্র খেটে খাওয়া মানুষের হাড় ভাঙা শ্রম ও নাক গড়িয়ে পড়া ঘামের প্রবাহ ধারা।
এ ধরণের পেশাদার ভিক্ষুকরা সব সময় শুধুমাত্র আমাদের মতো অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত এবং মধ্য ও নিম্নবিত্ত লোকদেরই নাগাল পায়। কিন্তু যাদের নাগাল পাওয়া উচিত, যারা ভিক্ষুকদের সাহায্য করার সামর্থ্য রাখে, ভিক্ষুকদের অধিকার যাদের হাতে বন্দি, দেশের সিংহভাগ বাণিজ্য ও সম্পদের ভান্ভার যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কখনো পায়না। শুধুমাত্র ভিক্ষুক কেন, ঝড়-বৃষ্টিও কখনো তাদেও নাগাল পায়না। তাদের অনুভূতিতে শীত, গ্রীস্ম ও বর্ষার কোনো পার্থক্য নেই। সব সময়ই তাদের আবহাওয়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তারা ভালো থাকলেই পৃথিবীর সবকিছু তাদের কাছে সমান্তরাল মনে হয়। প্রতিনিয়তই তাদের কাছে মনে হয় আগের যে কোন পরিস্থিতির চেয়ে এখনকার সময় খুবই মসৃণ।
সমাজের কোন বন্যা, খরা, ঘূর্ণি, দুঃখ, দুর্যোগ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, সাইক্লোন এবং সাইমুম কিছুই তাদের স্পর্শ করতে পারেনা। তবে সমাজের শান্তি, সমৃদ্ধি, প্রফুল্লতা, আবেগ, অনুরাগ, অনুগ্রহ, অর্থবিত্ত এসব কিছু ছেকে নেয়ার মতো এক অভিনব ছাকনি তাদের হাতে আছে। সমাজের কোন অপবাদ, অভিযোগ, অনুযোগও তাদের ঘাড়ে বর্তায়না। কিন্তু অপরাধ, অপবাদ, অভিযোগ এসব কিছু অন্যের ঘাড়ে ছাপিয়ে দেয়ার এক অদৃশ্য সক্ষমতা তারা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা মনে করে প্রতিনিয়ত মানুষের অধিকার হরণ করা কোন অপরাধ নয়। তাদের অপরাধ ঢেকে দেয়ার পর্দাও সমাজে খুব সস্তায় পাওয়া যায়। আবার অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিষ্পাপ থাকার প্রক্রিয়াও তাদের জানা আছে। তবে তাদের বিলাসবহুল মসৃণ জীবনের কোন আচড় লাগাটা সমাজের অন্যদের জন্য মহাবিপদের।
অর্থবিত্ত ও প্রাচুর্যের যেমন তাদের কোন অভাব নেই তেমনি সামাজিক দূরত্বেরও তাদের কোন সঙ্কট নেই। সামাজিক দূরত্ব ও মানুষের নিকট থেকে দূরত্বই তাদের জীবন ও জীবনের পাথেয়। জনসেবা করার উদ্দেশ্যে শপথ করে যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন তারা রাস্তায় চলার সময়ও জনসাধারণকে সরিয়ে রাখা হয়। যাতে তাদের গাড়ি যানজট ও মানবজট কোনটিতেই আটকা না পড়ে। পৃথিবীর অন্যান্য সম্পদ যেমন তাদের কোন অভাব নেই, তেমনি এ অপ্রতিরোধ্য মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব নামক আর্শিবাদেরও তাদের কোন সঙ্কট নেই।
করোনার মহামারিতে যে কারণে অসংখ্য মানুষের অনাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে, যে কারণে মানসিক যন্ত্রণায় মানুষের অভিগমন পরিবর্তন হয়ে গেছে, যে কারণে মানুষ আপনজনের লাশের সঙ্গেও সর্বকালের নির্মম আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছে, একই কারণে একটি গোষ্ঠি তাদের সর্বোচ্চ স্বার্থ সিদ্ধির সুযোগ নেয় এবং নিচ্ছে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানার কর্মীদের ছুটি বাতিল করার সুযোগ পেয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের বেতন স্থগিত করার সুযোগ নিয়েছে। বাড়িয়ে দিয়েছে কর্ম সময়। আর সঙ্গে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার ভয়ঙ্কর বার্তা তো আছেই।
যার কারণে সমাজের তথাকথিত উচু তলার লোকেরা এসবের অবাধ সুযোগ পেয়েছে তার নামই হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। শুধু মহামারির সময় নয়। সব সময়ই সামাজিক দূরত্ব তাদের নেশা এবং পেশা। আর সামাজিক দূরত্বই তাদের তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের মূখ্য মাধ্যম এবং এটিই তাদের জন্য আর্শীবাদ।
লেখক : মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
শির্ক্ষার্থী
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগ
ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়
abdullhamozumder@gmail.com
১ মে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ