কবি রত্নেশ্বর সরকারের একগুচ্ছ কবিতা শিল্প ও সাহিত্য / 
ফসল
আমি কোন আঘাতেই দুঃখ পাইনা
দুঃখ দিয়েই আনন্দের ফসল ফলাই
আমি কবি, কবিতায় ঢেকে রাখি
আমার আনাচে কানাচের সুখ দুঃখ গুলি
মুক্ত নীল আকাশ যেমন আমিও তাই
আমার বুকে ভাসমান মেঘ পিণ্ড গুলি
টাপুর-টুপুর ঝরে পড়ে লেখনীর আগে
কেউ বলে কবিতা কেউ বলে পাগলামি
যে যাই বলুকনা কেন আমি জানি
ও সবই আমার আপন ফসল
আমার টুকরো টুকরো সুখ-দুঃখের কথা গুলি
যখন কারো চোখের জল হয়ে অথবা
মুখের হাসি হয়ে ঝরতে দেখি
তখনই ভুল হয়ে যায় দুঃখ সুখের কথা
আবার নতুন বীজ বুনি ফসলের আশায় ।
************
পথ
কত পথ কত দিকে যায় সামনে পিছনে
ডাইনে আর বাঁয়ে সব দিকে খোলা পথ
পথ চেনা যায় পা বাড়ালে
প্রতিটা পথের একটা শেষ থাকে
শেষ থেকে শুরু হয় আবার অন্য পথ
ঠিকানা বিহীন কোন পথ নেই
যে ঠিকানায় যে পৌঁছাতে চায়
পথই পৌঁছে দেয় সেই ঠিকানায়
পথ ছাড়া পৌঁছাবার আর কোন পথ নেই ।
*************
অসুখ
রাত্রি এলেই অসুখ বাড়ে
ঘুম আসেনা চোখে
অন্ধকারেও চোখের তারা
আপন মনে জ্বলে
ভাসে অনেক স্মৃতির ছবি
অনেক ছবির মেলা
দিনের আলোয় পাইনা খুঁজে
সবই রাতের বেলা ...
রাতের বেলা একলা হই
কেউ থাকেনা কাছে
অতীত দিনের সঙ্গী সাথী
তখন সবাই আসে
কথা বলি গল্প করি
রাত কেটে হয় ভোর
ভোরের আলো ফোটার আগেই
পালায় যে ঘুমচোর ।
*********
অতীত
মনে পড়ে আর মন পোড়ায়
সে কোথায় আর আমি কোথায়
কথা দিয়ে কথা রাখেনি যে
তার কথা কেন ভাবি মিছে
ফুটে ছিল ফুল ডালে ডালে
ফুল নেই গাছ তবু ভাবে
আবারও এমন আসবে দিন
প্রজাপতি ডানা মেলবে রঙীন
সে কোথায় আর আমি কোথায়
কথাটাই শুধু ভাবায় আমায়
ছিলনা এমন কোন কথাই
ব্যথা শুধু আমি সব একাই
দিন যায় রাত আসে ফিরে
অতীত আমায় ঘিরে ধরে
সব মুখ চেনা কায়া কোথায় ।
ছায়া নিয়ে খেলে রাত পোহায়।
*************
দূর্বোধ্য
কবিদের হাব ভাব চাল চলন
সবই নাকি দূর্বোধ্য একদল পাঠকের মত
অন্যদল বলে আজকাল কবিতা কোথায়
শুধুই দূর্বোধ্য শব্দের কেরামতি
কবির কর্ণপাত নেই সে সব কথায়
কবি ভাবে মানুষ তো সবাই
হাত পা চোখ মুখ নাক কান
সকলেরই এক রক্তের রং টকটকে লাল
ক্ষেতের কিষান আর মহাজনে ভেদ নেই
তবুও দুস্তর ব্যবধান কারো কোঠা বাড়ী
বৌদের দামি দামি শাড়ি সোনা কাড়ি কাড়ি
কারো বা পাতার কুঁড়ে কিংবা খড়ের চাল
বৌদের পরনে জোটেনা শাড়ি পেটে ভাত
কেন এই ব্যবধান ? দূর্বোধ্য কেবল
কবির কবিতা ? সে তো প্রাত্যহিক ছবি ।
*********
গাছ
সব রাগ জল হয়ে গেলে
চোখের আগুন বুকের মধ্যে চলে যায়
সেখানে পোড়ে, পুড়তেই থাকে ।
যার পোড়ে সেই শুধু জানে
আর কারো অনুভব ছুঁতেও পারেনা
ঝিনুকে মুক্তার মতো কার কোনখানে
সঞ্চিত হয়ে আছে সম্পদ ।
দগ্ধ চোখে শুধু জল ঝরে
সে জলের ঝর্ণা ধারায় কত ছবি
সুপ্ত বীজের মধ্যে বেঁচে আছে গাছ ।
**********
ছায়া
মাঝে মাঝে কিযে হয় দূর ছাই
ভুলে যাই সব কিছু ভুলে যাই।
কোন পথে হেঁটে যাই এত পথ
রথে চেপে যাব রথ যদি পাই !
হয়তো বকুল গাছ নয়ত একলা বট
নয়ত নীরব কোনো অভিমান।
একা ভাবি ভুল করে, সত্যিতো একা আমি নই
সেই গাছে কত পাখি কলতান।
কত ছবি কত রঙ ভাসে আর
কানে-কানে বেজে ওঠে সেই সুর।
সেই সব ছেড়ে আজ কত দূর
একা হাঁটি পথে সাথী রোদ দূর।
রোদ আছে ছায়া নেই নাই থাক
ছায়া খায় মনে মনে ঘুরপাক।
**************
শোকফুল
শোক ফুল কখনও ঝরেনা
ক্রমশ গভীর থেকে গভীরে
হৃদয়ের গোপন কোন অলিন্দে
চির বিকশিত থাকে একান্তে।
যত দিন যায় ততো বেশি সুবাস
ছড়াতেই থাকে দেহ জুড়ে
পবিত্র করে মন প্রদীপ শিখা
আলোকিত চার দিক হৃদয় বাহির।
যে নেই সে নেই আছে তার ছায়া
যেখানেই চোখ রাখি অদ্ভুত ছবি
পরিচিত ঘ্রাণ পাই এ ভাবেই বাঁচি
অমর শোকফুল চিরকাল সাথী।
************
একা হলে
যখন আশে পাশে কেউ থাকেনা
বন্ধু - বান্ধব
আমি পায়ে পায়ে চলে যাই
নির্জন জলঙ্গী পাড়ে
যে আমার আশৈশবের চেনা জানা নদী।
নদীর পাড়ে গেলে আমি
অন্য মানুষ হয়ে যাই
অন্য ভাবনায় ভাবিত হই
নদীর মধ্যে আছে স্মৃতির পাহাড়
সে পাহাড় বেয়ে উঠে যাই
অনেক গভীরে নামি
আমার ভিতরে থাকা লুকোনো ছবি
আর সোনালী অক্ষরে লেখা খাতা
সব কিছু দেখি আর পড়ি
তার পর শেয়ালের ডাক শুনে ভাসি
ভাসতে ভাসতে ফিরে আসি
পরিচিত জনেদের মাঝে একা নই আর।
*****************
মধু লেবে গো মধু
দেহাতী যুবতী হাঁক দিয়ে যায়,
চাক ভাঙা মধু লেবে গো
বুক ভাঙা ব্যথা বুঝিনা
তাই চাক ভাঙা মধু কিনিনা
খাঁটি নয় মধু গুড় গোলা জল
অপবাদ দিতে ছাড়িনা
হিসাব কষেই জীবন কাটাই
জীবনের কথা ভাবিনা
চাক ভাঙা মধু হেঁকে যায় তবু
মধু যে কিনতে পারিনা।
************
তোমার ব্যাপার
হৃদয় ছিল বলেই সেখানে
একটা ফুল ফুটে উঠেছিল
ফুলটার নাম ভালোবাসা।
মন ছিল বলেই সেখানে
একটা স্বপ্ন জেগেছিল
যেটা ছিল নেহাৎ কল্পনা।
দুটো চোখ আছে বলেই
চোখে ভেসেছে ছবি
ছবিটা অবিকল তুমি
ফ্রেমবন্দী হবে কিনা সেটা
একান্তই তোমার ব্যাপার।
কবি পরিচিতি :
জন্ম - ১ লা এপ্রিল, ১৯৫২, রত্নেশ্বর সরকার, পিতা- কৌশিক চন্দ্র সরকার, মাতা - ননীবালা সরকার, শিক্ষা - কৃষ্ণনগর দেবনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন । পেশা - শিক্ষকতা, নেশা- সাহিত্য চর্চা।
অক্লান্তভাবে নিরলস কাব্য চর্চায় মগ্ন কবি দৈনন্দিন জীবন যাপনের সুখ-দুঃখ, পতন-উত্থান, হাসি-বেদনার গভীরের নানা দৃশ্য তুলে ধরেন পাঠকের সামনে। সম্পাদিত পত্রিকা- উত্তরণ, লেখক বাংলো, প্রবাহী।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ফসল, সরকার বাড়ী।
ঠিকানা - কবি রত্নেশ্বর সরকার, চাষাপাড়া, কৃষ্ণনগর-৭৪১১০১, নদিয়া।