Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

একুশে পদকপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায় আর নেই জাতীয়

একুশে পদকপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায় আর নেই

একুশে পদকপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় আর নেই।  সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ১২টার দিকে বারডেমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।  তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।  

বারডেম হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মল্লিক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  স্বজনরা জানান, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর তিনি বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন।   এর দুই দিন পর শ্বাসকষ্ট পাড়লে তাকে কৃত্রিম শ্বাস দেয়া শুরু হয়।  আজ সকালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।  

শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক অজয় রায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩৫ সালের ১লা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একইসাথে পদার্থ বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী ছিলেন।

স্কুল এবং কলেজ জীবনে পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাশ করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে সেখানেই করেন পোস্ট ডক্টরেট। ১৯৬৭ সালে শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন এবং অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। দেশি এবং বিদেশি বহু জার্নালে তার পেপার প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি পদে আসীন ছিলেন। তিনি সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির বিজ্ঞান বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং দক্ষিণ এশীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের পাশাপাশি তিনি মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং মুক্তান্বেষার সম্পাদক ছিলেন। কলামিস্ট হিসবেও তিনি দৈনিক সমকালে লিখেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক অজয় রায়ের বাংলাদেশের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে আগরতলা হয়ে কলকাতায় গমন করেন । সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসবে নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরসূরী হিসবে একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

অধ্যাপক অজয় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন‌ রোধে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন বৃদ্ধি পেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিয়ে ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি মনিটরিং সেল গঠন করে বিভিন্ন সংস্থার সাথে মিলে সংখ্যালঘুদের সহায়তা করেন। ইন্টারনেটে সংখ্যালঘুদের দুর্দশার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে' শিরোনামে সিরিজ শুরু করেন। ভোলার অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে বিভিন্ন নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং দাঙ্গায় যারা গৃহ হারিয়েছিলেন, তাদের গৃহ পুনর্নিমাণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের সাথে মিলে অধ্যাপক অজয় রায় ‘গণ তদন্ত কমিশন’ তৈরি করেন, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০০২ সালে। দেশের পাহাড়ি জনগণ এবং আদিবাসীদের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনও তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী ও বাঙালি অধিবাসীদেরকে অবিলম্বে সরিয়ে নেয়া দরকার।

অধ্যাপক অজয় রায় বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। তিনি বিজ্ঞানকে তরুণ প্রজন্মে বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেবার প্রয়াসে তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভার আয়োজন করেছিলেন। মুক্তমনার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করতেন তিনি। এ ছাড়াও তিনি মুক্তান্বেষা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসবে কাজ করেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। তিনি বাংলাদেশের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে তার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনারে পঠিত হয়েছে । বাংলাদেশের মুক্তমনা এবং মুক্তচিন্তক লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ স্বতন্ত্র ভাবনা তার পরিচালনায় প্রকাশিত হয়েছে অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে ২০০৮ সালে।

উল্লেখ্য, অজয় রায়ের ছেলে ব্লগার ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে জঙ্গি হামলায় নিহত হন।