নাজমুল হক নজীরের কবিতা সারল্যের সফল দর্শন : আলী আকবর শিল্প ও সাহিত্য / 
নাজমুল হক নজীর একজন কবি ও সহজাত সারল্য ভাবধারার সফল স্রষ্টা। যিনি যাপিত জীবনের অন্তঃসার দর্শনকে কাব্যিক বয়ানে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্তর দশকে যারা কবিতাকে আবেগ-অনুযোগ আর জাতিসত্তার উপাখ্যানে রূপ দিয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। শিল্প-সাহিত্যে সাবলীল প্রকাশ একটা বিশেষ দিক। শব্দকল্প বর্ণনার সাবলীল ভঙ্গিমা যে কোন রচনাকেই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। পাঠকমনে তৃষ্ণার প্রলেপ দেওয়ার জন্য কবি যে চিত্রবৈভব এঁকেছেন তাতেই তিনি সার্থক স্রষ্টা। যেখানে পঙক্তির পর পঙক্তি হৃদয়ঙ্গম করা যায় অবলীলায়।
সহজ করে লিখতে আমায় কহ যে
সহজ করে যায় না লেখা সহজে।
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন। আর যে সারল্যের কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন সেই সারল্য নাজমুল হক নজীরের কবিতায় দিব্যমান। তার কাব্যিক দৃষ্টিতে যে শস্যসম্ভারের সৃষ্টি তাতে সাবলীলতার অবাধ বিচরণ।
প্রকৃতির আকুল দর্শক ও সুন্দরের পূজারী হয়ে তিনি যে শব্দ শ্রম দিয়েছেন তাতে আমরা দেখি 'সুশীল সমাজ আর সুবর্ণ গ্রাম'। তার সেই সুবর্ণ গ্রামে দেখা মেলে;
কলমি ফুলে হিজল ফুলে
গাঁথি মালা সময় ভুলে
শ্যামল মাঠের ডাক দিয়ে যায়
হেলা খেলা নাই।
তার কবিতায় গ্রাম্য বালক থেকে শুরু করে রাজপথে রক্ত দেয়া বরকতের কথা। অর্থনৈতিক শোষণ মুক্তির জন্য লড়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা হারুনের কথা। কবি মুক্তির মিছিলে শ্লোগান তুলেছিলেন একটা উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে কিন্তু তা পূরণ হয়নি এখনও। বরং
মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারের লাইন প্রায় সমান সমান
শুধু মীর জাফরের লাইন..
বড় হতে হতে চলে গেছে মাঠের প্রান্ত সীমানায়।
(এখনো অনেক রাত, বকুল ভেজা পথঘাট)
স্বাধীনতা পেয়েও আমরা কি সত্যিকার অর্থে মুক্ত? সেদিন ছিনিয়ে তাজা প্রাণকে আজ বিকিয়ে দিচ্ছি রক্তের দরে। আমাদের সীমানা এখনও অরক্ষিত। সম্রাজ্যবাদী মীর জাফরের লাইন তাই দীর্ঘতর হচ্ছে। তবুও তিনি সপ্ন দেখেন কারণ;
আমিতো নবাব সিরাজের বংশধর
সালাম,বরকত সূর্যসেনের ভাই।-(আবেদন)
নাজমুল হক নজীরের সদ্য প্রকাশিত কবিতায় তিনি বিনয় মজুমদারের উদ্দেশ্যে বলেন,
আমাকে ক্ষমা করো বিনয় মজুমদার
প্রত্যহ যেভাবে মানুষের লাইন ক্ষুদ্র হচ্ছে
সময় যেভাবে হাঁটছে সরুপথে
হয়তো ভুলে যাবে একদিন।
আজ চারিদিকে যে জিঘাংসার আয়োজন তাতে সত্যি মানুষ আজ সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজ অমানুষদের লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ সাজার ভনিতা করছে।
তার কবিতায় ফুটে উঠেছে প্রেম-বিরহ, প্রাপ্তী -অপ্রাপ্তীর সরল সুর। জীবন সংসারে প্রেমের যে নীলপদ্ম ফুটে উঠেছে তা তিনি দেখেছেন এভাবে,
প্রেমের কবিতার মতো তুমি এলে /গোলাপ রাঙ্গা হয়ে একা একা/আমার ঘরের চালে যেন নূপুর নিক্কন/প্রত্যহ রাত হলে/এতোসব মনে পড়ে বারবার, মনে পড়ে/
বাতাসের বারান্দায় ভিটেমাটিস্বর গ্রাম।
আহা প্রেমের কি দারুণ উপমা! কি সব কল্পকথা। তিনি চিরতারুণ্যের সপ্ন দেখতেন। যৌবনকে সময়ের ফ্রেমে বেধে রাখার স্বপ্ন। একজন মানুষ কতটা সবুজমনের অধিকারী লিখতে পারেন;
জীবনে শুধু যৌবন চাই/ বয়সে চাই বসন্ত
পৌষ শ্রাবণ নবান্ন থাক/মানুষে মানুষে সুমন্ত-(স্বপ্নজট-কার কাছে বলে যাই)
কবির এমন উচ্চারণে অপূর্ব যৌবন বন্ধনা রচিত হয়েছে। আমরা সকলেই চাই চিন্তন পূর্ণ যৌবনের স্বাদ। কবিমনে এভাবেই বংশ পরম্পরার যৌবনের আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল। তবুও কি এক অপ্রাপ্তী নিয়ে তিনি বলেছিলেন,
‘এতো অবহেলা দিলে আমি নির্ঘাত রেগে যাবো,উপড়ে ফেলবো সমন্ত ফুলের গাছ’।
কবি কখনও রেগে থাকবেন তা হয় না। বরং তার উপড়নো ফুলগুলো দিয়েই আজ তাকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই। শুভ জন্মদিন শ্লোগানের কবি।
লেখক, শিক্ষার্থী
সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।