Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

মুন্সীগঞ্জ জেলা জুড়ে ব্রিজ-কালভার্ট ও খাল-বিল দখলের মহোৎসব চলছে মুন্সিগঞ্জ

মুন্সীগঞ্জ জেলা জুড়ে ব্রিজ-কালভার্ট ও খাল-বিল দখলের মহোৎসব চলছে

নদীবেষ্টিত মুন্সীগঞ্জের সরকারি খাল-বিল, নালা-ডোবা, ব্রিজ-কালভার্টসহ বিভিন্ন বাজারের সম্পত্তি দখলের মহোৎসব চলছে। বর্তমান ক্ষমতাসিন দলের নেতা-কর্মীসহ যে যার মতো করে দখল করে নিচ্ছে সরকারি সম্পত্তি। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও গোমতী ও ইছামতি এই পাঁচ নদীর বেষ্টনী দিয়ে আবৃত জেলার সীমানা। আর ছোট বড় হাজারো খাল-নালা দিয়ে এসব নদীর জল প্রবাহিত হতো জেলার সর্বত্র। মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মসহ যাতায়াতের এক সময় অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো খালগুলো।

সরজমিনে জেলার প্রতিটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী খালগুলো নামে-বেনামে দখল করে পরিবর্তন করে ফেলেছে তাদের রুপ। আর এভাবেই ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি খালগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই। যেন বলার কিছু নেই দেখারও কেউ নেই।

সরেজমিনে ঘুরে অভিযোগ পাওয়া যায়, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা এসকল কর্মে জড়িত। তবে সরকারি কর্মকর্তারও এতে পিছিয়ে নেই।

মুন্সীগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহমান ছিল “জুবলী” খাল যা বতর্মানে “জুবলী” রোড হয়েছে। শহর উন্নয়নের জন্য ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ মুন্সীগঞ্জ শহরে সফরে এসে খাল ভরাট করে সড়ক তৈরির ঘোষণা দেন। এরপর জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তা বাস্তবায়ন করে। ২০০৪ সালে শহর উন্নয়নের নামে আরেকটি (ইসলামপুর-মুন্সীরহাট) খালকে ভরাট করা হয় যা এখন দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। আর তা দখল করে নিচ্ছে নামে-বেনামে মসজিদ-মাদ্রাসা, মার্কেট, স্কুল নির্মাণের নাম করে। অথচ সরেজমিনে সেখানে এসব কোন প্রতিষ্ঠানই চোখে পরে নাই।

মুন্সীগঞ্জের অতিপ্রাচীন একটি হাট “মুন্সীরহাট” যেখানে এক সময় হাটের মতোই প্রতিদিন বাজার বসত। কারণ, সদর উপজেলার পাঁচটি চরের হাজার হাজার মানুষ বাজার-হাটের জন্য এখানে আসতো। আর ওই এলাকার মানুষদের একমাত্র যোগাযোগের বাহন ছিলো নৌকা। কালিদাস সাগর নামের খালটির ধলেশ্বরী থেকে শুরু মুন্সীরহাট হয়ে বাংলাবাজারের পদ্মায় গিয়ে শেষ হতো।

তেমনি মহেশপুর থেকে মাকহাটি রজতরেখা খাল, মাকহাটি থেকে ধামারন কাজলরেখা ও মাকহাটি থেকে দিঘীরপাড় হয়ে পদ্মা নদীতে মিলিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রনদ নামের খালটি। আর এসব খাল গুলো বিভিন্নভাবে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু দিয়ে ভরাট করে, খালের জায়গা দখল করে যাতায়াতের পথ সরু করে বন্ধ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।

এদিকে, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও বাজারের পাশে তালতলা-গৌরগঞ্জ-ডহরি খালের একটি বিশাল অংশ বিআইডব্লিউটিএ’র ২৮৬ দাগের জায়গা লিজের নামে দখল করে নিয়ে ভরাট করছে স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রভাশালী এক সিন্ডিকেট।
এবিষয়ে তৎকালীন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. শামসুদ্দোহা চৌধুরী খন্দকার বলেন, খালের পাড় কিভাবে লিজ দেয়া হয়েছে, কে দিয়েছে, তা ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা খাল খনন করি, ভরাট করি না। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এদিকে, বালিগাঁও বাজারের পাশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তালতলা-গৌরগঞ্জ ও ডহরি খালের একটি বিশাল অংশ লিজের নামে দখল করে নেয়ার ঘটনায় ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টার দিকে টঙ্গীবাড়ি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। বিআইডবব্লিউটিএ'র উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ড্রেজিং বিভাগ) রেজাউর রশীদ খন্দকার বাদী হয়ে টঙ্গীবাড়ি এ সাধারণ ডায়েরিটি (যার নম্বর ৫০৯) করেন। এর আগে একইদিন তিনি সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খাল দখলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্ত কার্যক্রম চালান।

স্থানীয়রা জানান, খালের পাড় দখল হয়ে গেলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ওয়ার আশঙ্কাতো রয়েছেই। কারণ, আড়িয়ল বাজারের ক্রেতারা বেশীরভাগ নৌপথে যাতায়াত করে। যেখানে ভরাটকরা হচ্ছে সেখানেই নৌঘাটটি।

এদিকে, জেলার শ্রীনগর উপজেলার একাধিক খাল ভরাট করে ফেলছে ভুমিখেকো সিন্ডিকেট। শ্রীনগর-ষোলঘর রাস্তার দেউলভোগ এলাকার খালের ওপর নির্মিত প্রায় চল্লিশ ফুট দীর্ঘ বেইলী ব্রিজের মুখটি ভরাট করে ফেলছে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এরফলে ঢাকার চকবাজার নামে পরিচিত দেউলভোগ, হরপাড়া, ভূইছিদ্র ও ষোলঘর এলাকার প্রায় শতাধিক একর ধানি জমি স্থায়ী ভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। এ জমি থেকে প্রতিবছর প্রায় সাত থেকে আট হাজার মণ বোর ধান উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয় স্থানীয় কৃষকরা। চরম বিপাকে পড়বে তারা। এ খালটি উপজেলার গোয়ালীমাদ্রা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদ্মায় গিয়ে ঠেকেছে।

স্থানীয় সিন্ডিকেটরা এতটাই প্রভাবশালী যে, উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বালু ভরাট করার তিনদিন পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুজন শ্রমিককে আটক করে থানা হাজতে আটকে রাখে। পরে মুচলেকার শর্তে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে ওই প্রভাবশালী ভুমিখেকোরা।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহানারা বেগম জানান, পানি নিষ্কাশনের নালা তৈরি করে দেওয়ার শর্তে আটককৃত শ্রমিকদেরকে জমির মালিক ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। বালু সরিয়ে না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এতো কিছুর পরও থেমে নেই তারা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রুপে আসে ভুমিখেকোরা।  আবার থেমে থেমে চলে তাদের খাল-নদী-নালা দখল ও ভরাটের কাজ।

এমনি ভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে গজারিয়া উপজেলার বেশ কিছু চলমান খাল। উপজেলার ভবেরচর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাজার হয়ে কালিতলা হয়ে মেঘনার সাথে সংযুক্ত খালটি বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ দিয়ে বালু ভরাট করছে। তবে বলার যেন কেউই নেই। উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর খাল, বাউশিয়া ইউনিয়নের বড়কান্দি খাল, তেতুইতলা খালসহ বিভিন্ন খাল প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ছাড়াও মোনায়েম কোম্পানি, আনোয়ার সিমেন্ট কোম্পানীর মতো বিভিন্ন কোম্পানী দখল করে নিয়েছে। মুছে দিয়েছে খালের চিহ্নটুকু।

মুন্সীগঞ্জ সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব-কাকালদি এলাকার “কাকলদি খাল” ও ইছাপুরা ইউনিয়নের পূর্ব শিয়ালদি এলাকার “শিয়ালদি খাল” সহ লৌহজং উপজেলার কনকসার এলাকার “কনকসার খাল” উপজেলার বেশ কয়েকটি খাল এভাবেই দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিন্ডিকেট।

এদিকে, মুন্সীগঞ্জ শহর লাগোয়া ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদী খালে পরিণত হয়েছে। এ দু’টি নদীর সিংহভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে নদী সংলগ্ন সিমেন্ট, কোল্ডস্টোরেজ, টেক্সটাইলস মিল, কারেন্ট জালের কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এছাড়া, টঙ্গীবাড়ির আব্দুল্লাহপুর থেকে বেতকা ও সিরাজদিখানের তালতলা পর্যন্ত ইছামতি নদীও দখল হয়ে যাচ্ছে। শহর লাগোয়া পঞ্চসার ইউনিয়নের শশ্মানঘাট এলাকার কালভাট্রের মুখটি বালু ভরাট করে দখল করা হয়েছে সম্পূণরুপে। ফলে সামান্য বৃস্টি হলেই সেখানে জলবদ্ধতার সৃস্টি হয় এবং বাড়ি ঘর ও উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবনটি সব সময় থাকে জলমগ্ন।

এসব এলাকার গ্রামবাসী ও ভুক্তভোগীরা জানান, আগে দেখতাম খাল খনন করা হতো, আর এখন খাল ভরাট করা হয়। সব পাল্টাইয়া গেছে। রাজনীতি করে এরাতো এখন খাল ভরাটের মহোৎসবে মেতেছে। এ উৎসবে সিন্ডিকেট, গ্রুপের অভাব নেই। এক সময় দেখা যাবে খাল-নালা-নদী বলে কিছুই নেই সব মরুভূমি হয়ে গেছে। এমন ঘটনা সরকারি কর্মকর্তাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়তই ঘটছে। যেন দেখার কেউ নেই।

এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক শায়লা ফারজানা জানান, খাল ভরাটসহ ফসলি জমি ভরাটের বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র ঘটনা স্থলে গিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে মোবাই কোর্টের মাধ্যমে জরিমানাও করা হয়েছে অনেককেই।

শহরের অবস্থিত মুন্সীরহাট খাল ও কাটাখালি খাল দুটি এখনো বহমান রয়েছে। যা বর্তমানে অনেক জায়গায়ই ভরে ফেলা হয়েছে। এবিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, এই খাল দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।