সময়ের উজ্জ্বল সঙ্গীত প্রতিভা বিন্দিয়া খান বিনোদন / 
বিন্দিয়া খান এদেশের একজন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী। বংশ পরম্পরায় সাংস্কৃতিক পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পিতার নাম উস্তাদ মোহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং উস্তাদ গুল মহম্মদ খান ছিলেন তার পিতামহ।
এবার ভাষার মাসে সুরগাঁওয়ে হেড মাস্টার ভয়েস (এইচএম ভয়েস) HM Voice আয়োজিত কবিতা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘কথাসন্ধ্যা’য় প্রধান অতিথির আসনে উপবিষ্ট বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী যে সঙ্গীত শিল্পীদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাদের প্রতিভার প্রশংসা করেছিলেন; শিল্পী বিন্দিয়া খান তাদের অন্যতম।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দ্বারভাঙ্গা জেলার তিরহুত শহরে ঐতিহ্যবাহী ডাগর ঘরানা পরিবারে উস্তাদ গুল মহম্মদ খানের জন্ম। গুল মহম্মদের পিতার নাম উস্তাদ আহাম্মদ খাঁজি। উস্তাদ আহাম্মদ খাঁজি ছিলেন দ্বারভাংগা স্টেটের মহারাজার রাজসভার গায়ক। পরবর্তীতে পটিয়ালা স্টেটের মহারাজা রাজেন্দ্র সিং-এর নিয়মিত সভা গায়ক।
উস্তাদ গুল মহম্মদ খান ১৯ বছর বয়সে ধ্রুপদ ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পারদর্শীতার সুবাদে ভুপাল স্টেটের নবাব নসরুল্লাহ খান বাহাদুরের সভাগায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯০৮ সালে গুল মহম্মদ খান ভাওয়ালের রাজার আমন্ত্রণে স্বপরিবারে ঢাকায় আসেন। এদেশে খেয়াল এবং ধ্রুপদ সঙ্গীতের প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে “অল ইন্ডিয়া রেডিও ঢাকা” কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরিয়া রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন।
উস্তাদ গুল মহম্মদ খানের কনিষ্ঠ পুত্র উস্তাদ ইয়াসিন খান। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং এদেশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসারে মনোনিবেশ করে সঙ্গীত রসিকজনের নজর কাড়েন। উস্তাদ ইয়াসিন খানের সুযোগ্য কন্যা প্রতিভাময়ী সঙ্গীতশিল্পী বিন্দিয়া খান। গানের জগতে পিতার কাছে তার হাতে খড়ি ১০ বছর বয়সে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দিয়েই শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন।
হারানো দিনের হিন্দি গান ও আধুনিক বাংলা গান শিখেছেন তিনি। এছাড়া ঠুমরি, দেশাত্মবোধক গানেরও তালিম নিয়েছেন। বাবাই ছিলেন তার সঙ্গী জীবনের একমাত্র গুরু। গানের প্রতি তার একাগ্রতা আর নিষ্ঠায় আশান্বিত বিন্দিয়ার বড় খালা তাকে অনেক অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং তাকে ভবিষ্যতের "লতা মঙ্গেশকর" হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
পিতার মৃত্যুর পর সংগীত চর্চা তথা তালিমের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা দেখা দেয়- যা বিন্দিয়া দিনে দিনে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি তার মা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাবা-মা’র অনেক আদরের সন্তান বিন্দিয়া, মাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন । অনেক প্রতিবন্ধকতাও নেমে আসে তার জীবনে। মায়ের প্রতি ছিল তার সীমাহীন আস্হা ও নির্ভরতা।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণে মা তাকে সবসময় উৎসাহিত করতেন এবং তিনি সাধারণ শ্রোতাদের পাশে বসে বিন্দিয়ার গান শুনতে পছন্দ করতেন।
অনুষ্ঠান শেষে মায়ের আলোক উদ্ভাসিত মুখ বিন্দিয়ার মনকেও আনন্দ-আপ্লুত করেছে। মা যে কী সম্পদ ছিলেন শিল্পী বিন্দিয়ার জীবনে তা ভাষা দিয়ে পরিপূর্ণভাবে গাঁথা যাবে না হয়তো। অতুলনীয় মায়ের কথা বলতে গিয়ে এ শিল্পীর কণ্ঠ ধরে আসে। চোখের কোণ মনের অজান্তেই ভিজে যায়।
আপনজন বিয়োগে একটা সংকটও বিন্দিয়াকে ক্ষত-বিক্ষত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু, এই প্রতিকূলতায়ও হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারেনি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশ যাবার পরিকল্পনা রয়েছে বিন্দিয়া খানের। বংশের ঐতিহ্যগত ধারা অব্যাহত রাখার সংকল্প ও স্বপ্ন তার চোখে-মুখে দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়।
প্রতিভাময়ী শিল্পী বিন্দিয়া খানের অর্জন অনেক। তিনি জি-বাংলায় সা রে গা মা পা-তে ৮টি Episode সম্পন্ন করে সেরা ২০ জনের তালিকায় ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সঙ্গীতশিল্পী। বিভিন্ন কর্পোরেট প্রোগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। চ্যানেল আই-এর বাংলা উৎসবে ঠুমরী ও খেয়াল পরিবেশন করেন।
তার রয়েছে ২টি একক অ্যালবাম ও ১টি দ্বৈত অ্যালবাম এবং ৪০টি মিক্সড অ্যালবাম।
চলচ্চিত্রের গানেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। ‘ঢাকার কিং’, ‘ফাঁদ দ্য ট্রাপ’, ‘মামা মারে ছক্কা’, ‘চাঁদকথা’সহ আরো কটি চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। এছাড়া, প্রায়ই তিনি বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
এসব অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শিল্পী বিন্দিয়া খান যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়ে থাকেন। বিশেষ করে তার মূলধারার চর্চা বিদগ্ধ সঙ্গীতপিপাসুদের এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে সমানভাবে প্রিয়তা অর্জন করেছে।
হেড মাস্টার ভয়েস (এইচএম ভয়েস) HM Voice’এর আয়োজনে জনপ্রিয় কবি ও গীতিকার শেখ নজরুল’র ২৫টি মৌলিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বিন্দিয়া খান। ২৫টি গানই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। যে সময়ে শিল্পীরা মৌলিক গান বিমুখ- ঠিক সেই সময়ে মৌলিক গানের প্রতি এই শিল্পীর প্রবল আগ্রহ লক্ষণীয়। যেমন- ঠুমরি ঘরানার ‘মনটা নিয়ে’, ধ্রুপদী ঘরানার ‘দু’কথা’, ভাষার গান ‘বাঙাল’, দেশের গান ‘মায়ের কোল’, বৈশাখের গান ‘বৈশাখি মেয়ে’, কিংবা পূর্ণ আধুনিক গান ‘এলোমেলো সিঁথি’ এমনি তার প্রতিটি গান শ্রোতার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
এই কর্মযজ্ঞের পাহাড় মাড়িয়ে নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর নিরন্তর সাধনা দিয়ে সাধারণের অনুমানের সীমানা পেরিয়ে তিনি যদি পৌঁছে যান তাঁর প্রাপ্য ভুবনে, তাহলে আমাদের অবাক হবার কিছু নেই। আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম।
লেখক : অরবিন্দ আদিত্য