Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী ইশতেহার রাজনীতি

আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী ইশতেহার

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার (১৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত সেই ইশতেহারটি নিচে তুলে ধরা হলো।

নির্বাচনি ইশতেহার-২০১৮

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
ভাষণ : শেখ হাসিনা, সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, ঢাকা।
মঙ্গলবার, ৪ পৌষ ১৪২৫, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ।

সুধি মন্ডলী। আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের সবাইকে বিজয়ের মাসের শুভেচ্ছা।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় দেশবাসী এবং দেশের বাইরে যাঁরা এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদেরও শুভেচ্ছা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলখানায় নিহত জাতীয় চারনেতা - সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপটেন এম মনসুর আলী এবং এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানকে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ এবং ২-লাখ নির্যাতিত মাবোনকে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদ পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জানাচ্ছি সালাম।

আমি গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের শিকার আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, আমার তিন ভাই- ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ও দশ বছরের শেখ রাসেল- কামাল ও জামালের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জামিলসহ সেই রাতের সকল শহিদকে। আজকের দিনে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দকে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা অকাতরে জীবন দিয়েছেন সেই ভাষা শহিদদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

স্মরণ করছি, ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২২ নেতা-কর্মীকে। স্মরণ করছি ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত জোটের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ.এম.এস কিবরিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজউদ্দিনসহ ২১ হাজার নেতাকর্মীকে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে এবং ২০১৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামাত জোট পরিচালিত অগ্নি সন্ত্রাস ও সহিংসতায় যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং আহতদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। সেলিম, দেলোয়ার, নূর হোসেন, বাবুল, ফাত্তাহ, রাউফুন বসুনিয়াসহ স্বৈরাচার বিরোধী এবং ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সকল শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

প্রিয় দেশবাসী, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীকে লক্ষ্য করে আমরা নির্বাচনী ইশতেহার রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছিলাম। যার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। ২০১৪ সালে দশম নির্বাচনের আগে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছিলাম। 

আপনারা ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মত সরকার পরিচালনার ম্যান্ডেট দিয়ে সেই রূপকল্প বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। সাফল্যের সবটুকু আপনাদের অবদান।

সুধী, আজকের বাংলাদেশ আর্থিক দিক থেকে যেমন শক্তিশালী, তেমনি মানসিকতার দিক থেকে অনেক বলীয়ান। ছোট-খাটো অভিঘাত বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারবে না। ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করেছে।

মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের উপর। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ থেকে ২১.৮ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি আজ বাংলাদেশ। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার প্রায় ৫ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি থেকে প্রায় ২২ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩১তম। এইচ.বি.এস.সি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৭.৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ১০.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ ভূখন্ডের যা কিছু মহৎ অর্জন ও প্রাপ্তি, সবকিছু অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার উৎখাত এবং ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার আগে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। শূন্য কোষাগার, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্ধ কলকারখানা নিয়ে জাতির পিতা পথচলা শুরু করেছিলেন। এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল এক দুরূহ কাজ। তার উপর শুরু হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এসব প্রতিবন্ধকতা এবং ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশকে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয়েছিল। আর তখনই দেশের রঅগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়।

তাঁর হত্যার পর ১৯৭৫ পরবর্তী শাসকেরা বাংলাদেশকে পর-নির্ভরশীল, ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করেছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল। এ সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে। বাংলাদেশ মানেই ছিল বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, কঙ্কালসার মানুষের দেশ। একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে ১২ই জুনের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। একুশ বছর পর আবার বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়, জনগণের সরকার পায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল। এই ৫ বছর ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বর্ণযুগ। আর্থ- সামাজিক খাতে দেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করে। এ সময় আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি এবং ভারতের সঙ্গে ৩০-বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি স্বাক্ষর করি। যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ করি এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করি।

এছাড়া, কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করি। দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য দুস্থ ভাতা, স্বামী-পরিত্যক্তা ও বিধবা মহিলাদের জন্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ইত্যাদি কর্মসূচি চালু করি। ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। ২০০১-পরবর্তী ৫ বছর ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এক বিভিষীকাময় সময়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ।

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার, খুলনার এডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, নাটোরের মমতাজ উদ্দিনসহ ২১ হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে হত্যা করা হয়। হাওয়া ভবন তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং বিদেশে পাচার করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা-ভাই, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ নানা জঙ্গিগোষ্ঠি সৃষ্টি করা হয়। যশোরে উদীচির অনুষ্ঠান, রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ অফিস এবং পল্টনে সিপিবি’র সভায় বোমা হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হামকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান ও আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বোমা হামলা করে হত্যা চেষ্টা, ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট সারাদেশে প্রায় ৫’শ স্থানে একযোগে বোমা হামলা, একই বছর গাজীপুরে বার ভবনে বোমা মেরে ১০ জন হত্যা, শরীয়তপুরে দুই বিচারক হত্যাসহ সারাদেশে অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে এসব জঙ্গি গোষ্ঠি।

২০০৪ সালের ২১-এ আগস্ট বিএনপি-জামাত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের র‌্যালিতে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালোনো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রাণে রক্ষা পেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয় এবং ৫০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়। আহতদের অনেকেই এখনও শরীরে অসংখ্য স্প্ন্টিার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় জীবনযাপন করছেন।

প্রিয় দেশবাসী,একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আবারও ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শ্লোগান সংবলিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।আমরা আমাদের ইশতেহার এমনভাবে তৈরি করেছি যাতে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারি। একইসঙ্গে ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গুলোর ধারাবাহিকতা ২০১৮-এর নির্বাচনি ইশতেহারেও রক্ষিত হয়েছে।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনি ইশতেহার পুস্তিকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে এই স্বল্প সময়ে তা সবিস্তারে তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমি সংক্ষিপ্তাকারে কয়েকটি বিষয়গুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি।

৩.১ গণতন্ত্র, নির্বাচন ও কার্যকর সংসদ : বিগত দশ বছরে জাতীয় সংসদই ছিল সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করব। সংসদকে আরও কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একইসঙ্গে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, গণমাধ্যম, বিচারবিভাগকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

৩.২ আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষা : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিচার বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিচারক নিয়োগের পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, বিচারকদের জন্য যৌক্তিক বেতন কাঠামো ও সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ, গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠা, বিরোধ নিরসনে বিকল্প পদ্ধতির ব্যবহার, প্রতি জেলায় লিগ্যাল এইড স্থাপনসহ বিচারকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে।

আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার, জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২১-এ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছি এবং গ্রেফতারকৃত দণ্ডিতদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় ও সাহায্য সহায়তা লাভের সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা হবে। সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোন প্রচেষ্টা প্রতিহত করা করা হবে। মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।

৩.৩ দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন : প্রশাসনের সর্বস্তরে ই-গভর্নেন্স চালু করা হয়েছে এবং জনসেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’ কার্যকর করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং সম্মানজনকভাবে জীবনধারণের জন্য বেতন-ভাতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ অব্যাহত থাকবে। প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়-পরায়ণতা এবং জনসেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।

৩.৪ জনবান্ধব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলা : পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১০ বছরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, পিবিআই, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, রংপুর রেঞ্জ, রংপুর আরআরএফ, ময়মনসিংহ রেঞ্জ, ২টি র‌্যাব ব্যাটালিয়ন, সাইবার পুলিশ এবং গাজীপুর ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, এন্টি টেররিজম ইউনিট এবং কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পেলে আগামী ৫ বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে জনবল নিয়োগ করা হবে।

৩.৫ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ : জঙ্গিবাদ, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করব। দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা হবে। আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি চালুর মাধ্যমে দুর্নীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে।

৩.৬ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও মাদক নির্মূল : জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রতি আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হবে।

৩.৭ স্থানীয় সরকার : জনগণের ক্ষমতায়ন: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদসহ পৌরসভা ও সিটিকর্পোরেশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করা হবে। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে অধিকতর আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করা হবে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা উন্নত ও প্রসারিত করার জন্য সরকারের সাহায্য ও উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। নগর ও শহরে ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, পরিকল্পিত উন্নয়ন এবংনগর ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

৩.৮ সামষ্টিক অর্থনীতি : উচ্চ আয়, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন : আগামী ৫ বছরে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ।২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।

৩.৯ অবকাঠামো উন্নয়নে বৃহৎ প্রকল্প (মেগা প্রজেক্ট) : দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে: পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর,ঢাকা মাস-র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, মহেষখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পদ্মাসেতু রেল সংযোগ এবং চট্রগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন। আওয়ামী লীগ এসব মেগা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে দৃঢ়সঙ্কল্প। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। পায়রা বন্দরের পরিপূর্ণ উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। সোনাদিয়াগভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।এলএনজি টার্মিনাল বাস্তবায়িত হয়েছে। ইতোমধ্যে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে।

৩.১০ ‘আমার গ্রাম - আমার শহর’: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ:আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ওবাস্তবায়ন করব। শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিব। আগামী ৫ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছেযাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সকল গ্রামকে জেলা/উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা/উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট/তথ্য প্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।

৩.১১ তরুণ যুবসমাজ : ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’:‘সোনার বাংলা’-এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রধানতম শক্তি হচ্ছে যুবশক্তি। দেশের এই যুবগোষ্ঠিকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্য অর্জনে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রসারিত করা হবে। প্রতিটি উপজেলায় ‘যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্য সম্বলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেইজ তৈরি করা হবে। তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থান ব্যাংক এর মাধ্যমে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা ইতোমধ্যে প্রদান করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সুবিধা আরও বিস্তৃত করা হবে। তরুণদের সুস্থ বিনোদনের জন্য প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তোলা হবে একটি করে ‘যুব বিনোদন কেন্দ্র’। প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘যুব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলা হবে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে আমরা আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার যুব/যুব মহিলাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

৩.১২ নারীর ক্ষমতায়ন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ’ এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। নারীর প্রতি সকল বৈষম্যমূলক আচরণ/প্রথা বিলোপ করা হবে। বাল্যবিবাহ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা হবে। নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

৩.১৩ দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাস : বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ৪ কোটি ৯২ লাখ মানুষ বিভিন্ন প্রকার আর্থিকসহযোগিতা পাচ্ছেন। আগামি ৫ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে এবং সকলের ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হবে। দারিদ্র্যের হার ১২.৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনের নিয়মিত রোজগার নিশ্চিত করা হবে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে। সহজ শর্তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধকমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করা হবে।

৩.১৪ কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি : খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিশ্চয়তা:বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের অভূতপূর্ব সাফল্য বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সফল ধারা অব্যাহত রাখা হবে। কৃষি উপকরণের উপর ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি সুলভ ও সহজপ্রাপ্য করা হবে।কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা হবে। ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং কৃষিপণ্যের দক্ষ সাপ্লাই চেন/ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা হবে। কৃষি গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।ছোট ও মাঝারি আকারের দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামার প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনমত ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতি সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে।

৩.১৫ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট আর দৈনিক সরবরাহ ছিল ৩২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২০২০ সালের মধ্যে সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ৫,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে।

৩.১৬ শিল্প উন্নয়ন : কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প উন্নয়নে জোর দিয়ে যাচ্ছি।সারাদেশে ১০০টি সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এ পর্যন্ত ৮৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং ১৪টির কাজ এগিয়ে চলছে।অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো আনুমানিক অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করবে এবংপ্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে আর্থিক প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হবে। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে আধুনিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আইটি শিল্প পার্ক স্থাপন করা হবে এবং এসব শিল্প পার্কে আগামী পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

৩.১৭ শ্রমিক কল্যাণ ও শ্রমনীতি : ৪৩টি শিল্প খাতের মধ্যে ৪০টি খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০০৮ সালের ১৬০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শিল্প শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা করা হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য ৪ মাসের বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি বাস্তবায়ন করা হবে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। শ্রমিক, হতদরিদ্র এবং গ্রামীণ ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের জন্য রেশনিং প্রথা চালুকরা হবে।

৩.১৮ শিক্ষা : আমরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যুগোপযোগী শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছি। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সর্বমোট ২৬০ কোটি ৮৫ লক্ষ ৯১ হাজার বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে ১০০টি উপজেলায় এ ধরনের ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে। শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে সর্বাত্মকপ্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সকল গ্রামে, আধা মফস্বল শহরে এবং শহরের নিম্ববৃত্তের স্কুলসমূহে পর্যায়ক্রমে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করা হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত উপবৃত্তি প্রদান অব্যাহত থাকবে।মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যর্পূণ করা হচ্ছে। কওমী মাদ্রাসার দাওয়ারে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স-এর সম-মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের বেতন গ্রেডসহ শিক্ষাখাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়ে গেছে, তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিরসন করা হবে।

৩.১৯ স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ : বর্তমানে সারাদেশে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামীণ জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা এবং ৩০ প্রকার ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু এখন ২০০৯ সালের ৬৬.৮ বছর হতে ৭২.৮ বছরে উন্নীত হয়েছে।১ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের উপরে সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। সকল বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভবনসহ সকল সুবিধা পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ করা হবে।

৩.২০ যোগাযোগ :  বিগত ১০ বছরে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এ সময়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুত, সম্প্রসারণ, সংস্কার বা কার্পেটিং করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, নবীনগর-চন্দ্রাসহ এ পর্যন্ত প্রায় ৪২০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চারলেন বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছে। ৯১৪টি সেতু, ৩ হাজার ৯৭৭টি কালভার্ট নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫২ হাজার ২৮০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করা হয়। এছাড়া, ৭৫ হাজার ৭৭৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক ১৩ ও ৩১ হাজার ৬৩৭ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণ বা পুনর্বাসন করা হয়। ৩ লাখ ১ হাজার ৩৪১ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ করা হয়।ঢাকা মহানগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত অংশ পরের বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হবে। তৃতীয় পর্যায়ে পল্লবী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ৪.৭ কিলোমিটার অংশ চালু হবে ২০২২ সালে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জের কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ চার-লেন বিশিষ্ট প্রথম ঢাকা এলিভেটড এক্সপ্রেসওয়ে তিনটি পর্বে নির্মিত হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া হয়ে চন্দ্রা পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া, ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামে সাভারের হেমায়েতপুর হতে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রকল্প হাতে নেওয়াহয়েছে।

ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু করা হবে। দেশের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোকে আধুনিকায়ন করা হবে। আগামী ৫ বছরে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। ঢাকার চারপাশের ৪টি নদী-খালগুলোকে খননের মাধ্যমে নদী তীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে।একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দরগুলোর আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত করা হবে। রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা হবে।মহাসড়কের পাশে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নিরপত্তার জন্য আন্ডারপাস/ওভারপাস র্নিমাণ করা হবে। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করার জন্য যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করা হবে।

৩.২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নপূরণ : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি:৫ হাজার ৭৩৭টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮ হাজার ২০০টি ই-পোস্ট অফিসের মাধ্যমেজনগণকে ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে।ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে মহাকাশ বিজ্ঞানের যুগে। জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আমরা ২০২১-২৩ সালের মধ্যে ৫-জি চালু করব। ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহারের মূল্য যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে।

৩.২২ সমুদ্র বিজয় : ব্লু-ইকোনমি- উন্নয়নের দিগন্ত উন্মোচন মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রভিত্তিকঅর্থনৈতিক কর্মকা-, সামুদ্রিক পর্যটন শিল্প ইত্যাদি খাতে কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।আমরা দায়িত্ব পেলে সমুদ্র সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করব।

৩.২৩ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষা : ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করি এবং এর আওতায় ১৪৫টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডে’ বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে। উৎপাদনশীল বনের আয়তন ২০১৫ সালের ১৩.১৪ শতাংশ হতে ২০ শতাংশে উন্নীতকরণ করা হবে।

৩.২৪ শিশু কল্যাণ : আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা সুদৃঢ় সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৃত্তি ও নানাবিধ কর্মকা- উন্নত ও প্রসারিত করা হবে। পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা, হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশুসদন প্রতিষ্ঠা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা উন্নত ও প্রসারিত করা হবে।

৩.২৫ প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ কল্যাণ : প্রতিবন্ধী সকল শিশুর সুস্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা হবে। প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাফেরা, যোগাযোগ, চিকিৎসা সহজ করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।প্রবীণদের জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম গ্রহণ, প্রবীণদের বিষয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৩.২৬ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ ও মুক্তি?