Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পান্নার মাদারীপুর

স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পান্নার


১৯৭১ সালে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ রাজদী গ্রামের এমএ কাদের সিদ্দিকীর ছেলে শহীদ নুরুল আলম পান্না তখন টগবগে তরুণ। বরিশাল জেলার  গৌরনদী সরকারী কলেজের তিনি ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র জীবনে তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে। তিনি ছিলেন কলেজের গরীব ছাত্র-ছাত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রয়োজনে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে হলেও গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতা করতেন। চলা-ফেরায়, কথা-বার্তায় ছিল নিজস্ব স্বকীয়তা। দেশপ্রেমিক, পরোপকারী, আত্মপ্রত্যয়ী, স্বাধীনচেতা ও উদ্যমী এক যুবক। 

১৯৭১ সালে দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। চলে আসেন নিজ গ্রামে। ১৯৭১ সালের মে মাসে যোগ দেন ৩০৩ নম্বর রাইফেলে। মেজর মনজুর নেতৃত্বে ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে কালকিনি অঞ্চলে নুরু কবিরাজের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধকালীন তাঁর কাজ ছিল পাক হানাদার বাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে উনিশ একাত্তর সালের ১০ অক্টোবর কালকিনি উপজেলার ফাসিয়াতলা বাজারে যান। সেখানে রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী তাকে আটক করে মাদারীপুর এ.আর হাওলাদার জুট মিলের মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে বেয়নেট দিয়ে তাঁকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় । হত্যা করার পর মৃতদেহ নিশ্চিহৃ করে ফেলা হয় । আজ স্বাধীনতার সাত চল্লিশ বছর পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের কাছে খোঁজ নিয়ে শুনতে হয় লজ্জাজনক এক ইতিহাসের। তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও অন্তর্ভূক্ত হয়নি। শহীদ পান্নার স্মরণে এলাকাবাসীর উদ্যোগে নিজ গ্রামে ১৯৭৩ সালে শহীদ পান্না স্মৃতি সংঘ স্থাপিত হয়। যার নিবন্ধন নম্বর ফÑ০০৬৬। সেটাও আজ বিলুপ্তির পথে। অর্থাভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ঘরটি। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রণীত তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত ছিল। কেন কী কারণে চুড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম নেই সে ইতিহাস সবার আজও অজানা। অথচ ১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন জমাদার রচিত ‘মাদারীপুর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিকথা’র পঁচিশ পৃষ্ঠায় তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শহীদ হওয়ার ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘মুক্তি বার্তা’র দ্বিতীয় বর্ষের দশম সংখ্যায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত আছে। শহীদ পান্নার মুক্তি বার্তার নম্বর- ০১১০০২০৩৭০। শহীদ পান্নার ভাই অধ্যাপক জহিরুল আলম ডালিম ২০০৯ সালের ৩ মার্চ তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মনিরুজ্জামান বরাবর একটি আবেদন করেন। তার আবেদনের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৎকালীন জেলা প্রশাসক শশী কুমার সিংহ বরাবর একটি আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনের ২ বছর পরও শহীদ পান্নার নাম তালিকাভূক্ত হয়নি। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর উপজেলা পরিষদের সভায় কালকিনি-ভূরঘাটা সড়কের কাঠেরপোল থেকে বড়বাড়ি পর্যন্ত সড়কের নাম ‘শহীদ পান্না সড়ক’ নামে করার প্রস্তাব গৃহিত হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২ ফেব্ররুয়ারী শহীদ পান্নার নাম তালিকাভূক্ত করার জন্য পুণরায় আবেদন করা হয়। তাই শহীদ পান্নার পরিবার এখনো তাঁর নাম তালিকাভূক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় দিন গুণছে। তবে ২০১৭ সালে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু হলে সেখানে নুরুল আলম পান্নাকে গণ-শহিদ হিসাবে রাখা হয়েছে। কিন্তু পান্নার পরিবারে দাবী তাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সরকারি চুড়ান্ত তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত হয়নি কেন ?  এ বিষয় শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে । শহীদ পান্নার ভাই ছোট অধ্যাপক জহিারুল আলম ডালিম জানান,‘স্বাধীনতার সাত চল্লিশ বছর পরও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি তালিকাভুক্ত না হওয়ার কারণ জানিনা। তবে আমরা সরকারি কোন সাহায্য চাইনা। শুধু চাই আমার ভাইয়ের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত হোক। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছই শুরু হলে আমি ( শহীদ পান্নার ছোট ভাই ডালিম) উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে আবেদন করি। এরপর আমাকে ডাকলে কাগজপত্র ও সাক্ষি না থাকার কারণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় না রেখে গণ-শহীদের তালিকায় রাখা হয়েছে। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে শহীদ পান্নার নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন মঞ্চনাটকেও তার চরিত্র ও শহীদ হওয়ার কারণ উল্লেখ করেছি। আমি আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সদয় বিবেচনা করবেন।  কালকিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা জাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য মো. আব্দুল জলিল জানান, ২০১৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই শুরু হয়। নুরুল আলাম পান্নার ছোট ভাই অধ্যাপক জহিরুল আলম ডালিম কালকিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির নিকট আবেদন করেন। আবেদনের পরিপেক্ষিতে যাচাই বাছাই কমিটর নিকট সঠিক কাগজপত্র ও সাক্ষি উপস্থাপন করতে পারে নাই। যার পরিপেক্ষিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রমানিত হয় নাই। তারপরও তিনি  গণ-শহীদ হিসাবে প্রমানিত হয়েছেন।