Opu Hasnat

আজ ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার ২০২৪,

মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন মানুষের জীবনধারা মুন্সিগঞ্জ

মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন মানুষের জীবনধারা

বাংলার অন্যান্য ভূ-খন্ডের মতো মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন মানুষেরা পড়তো সেলাই বিহীন কাপড়। ব্যবসায়ী এবং টাকা ওয়ালা পরিবারের পুরুষেরা দুই হাত পাশ এবং সাড়ে তিন হাত লম্বা সেলাই বিহীন লুঙ্গি বা ধুতি পড়তো। যা দেখতে একটি গামছার মতো দেখাতো। এটি সাদা, গাঢ় সবুজ ও লাল রং এর হতো। মেয়েরা পড়তো পাতলা সুতায় বোনা শাড়ী।

তাঁতেই বোনা হতো এ সকল শাড়ী। মেয়েদের শাড়ি উত্তরবাস কোন কোন ক্ষেত্রে লতাপাতা ও জ্যামেতিক চিত্র আঁকা থাকতো। তবে বিভিন্ন মুর্তি, দেয়াল চিত্র ও বিদেশী পর্যটকদের লেখা থেকে জানা গেছে মুন্সীগঞ্জ, সোনারগাঁ, পুন্ডুবর্ধন, পান্ডুয়া, ফিরোজাবাদের মেয়েরা পায়ের গোছা পর্যন্ত আটসাঁট পাজামা পড়তো। দেহের উপরের অংশের বামপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিত এক খন্ড কাপড় যা ওড়না। প্রত্মতাত্বিকদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন কালের মেয়েরা শরীরের উপরের অংশ অনাবৃত রাখতো। অথবা সেলাই বিহীন একটি গামছা জাতীয় কাপড় পড়তো।

এমনই অবস্থা সমগ্র বাংলার শহর-শহরতলিতে প্রচলিত ছিল। ন্যাংটি বা স্বল্প ভূষণ পড়তো সন্যাসী তপস্বী ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা। খাটো পাজামা সৈনিক ও কুস্তীগীররা পড়তো। সাহিত্য লিপিমালা ও মুর্তি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের পুরুষ ও নারীরা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই লম্বা চুল রাখতেন।

ছেলে মেয়ে উভয়ে চুলের খোপা করে রাখতো। মেয়েরা চুলে বেনুনী করতো, চেলি ভাঙ্গতো দুই তিনটি। বেনুনীর শেষ প্রান্তে রঙ্গিন ফিতার ফুল বানাতো। ছেলে মেয়ে উভয়েই গয়না পড়তো। প্রাচীন সাহিত্যে কুন্ডল, হার, অঙ্গদ, কেয়ূর, বলয়, মনিমেখলা ও রসনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রাপ্ত অর্ধনারীশ্বর, শিব-পার্বতী, বিষ্ণু, তারা, রজত, স্বরস্বতী, নটরাজ মুর্তিতে উল্লেখিত গয়না গুলো দের্বদেবীদের পরিধানে দেখা যায়। যা মুন্সিগঞ্জের সাধারন মানুষেরাও ব্যবহার করতো। প্রাচীন মুন্সিগঞ্জের নারীরা কপালে কাজলের ফোটা দিতো। চোখে কাজল ব্যবহার করতো।

হাতে স্বর্ন ও শাখার বালা ব্যবহার ছিল মেয়েদের। ছেলে মেয়ে উভয়েই মাথায় তিলের অথবা শরিসার তেল ব্যবহার করতো। মেয়েরা হাতে মেহেদী, কাঁচা হলুদ ও আলতা পড়তো। চন্দন ও জাফরানের ব্যবহার হতো। নারীরা সিদুর রেখা দিত সিথিতে। কাঠের পাদুকা বা খরম ব্যবহার করতো।

সাধারন মানুষ খালি পায়ে চলাফেরা করতো। রাজকীয় লোকেরা চামড়ার জুতা পড়তো ময়নামতি, পাহাড়পুর পোড়ামাটির ফলক ও মুন্সীগঞ্জের মূর্তি গুলো এর সাক্ষ্য বহন করে চলছে। 

প্রাচীন মুন্সীগঞ্জে সুতীবস্ত্র ও সূতি কাপড় তৈরী হত তাঁতীকান্দি, আব্দুল্লাপুর, রুহিতপুর। 
চীনদেশের বিবরণ থেকে জানা যায় ত্রয়োদশ শতকে মুসলমান পুরুষেরা সাদা রঙের সূতী লম্বা জামা পড়তো। খুব সম্ভবত একে জুব্বা, পাঞ্জাবি বলে। মাথায় পাগড়ি ও টুপি পড়তো।

মাথার চুল কেটে ফেলতো ও পায়ে ভেড়ার চামড়ার তৈরী জুতা পরতো। যাতে সোনালী জরির কাজ থাকতো। মুসলমান মেয়েদের গায়ের রং ফর্সা হতো এজন্য অঙ্গরাগ পরতো না। তারা কানে মূল্যবান পাথর ও সোনার দুল পরতো, গলায় পরতো হার হাতে সোনার চুরি, আঙ্গুলে আংটি ও পায়ে মল পড়তো। এটি ধনি মুসলমানরা ব্যবহার করতো।
 

মুন্সীগঞ্জের খাবার-দাবার
কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর এর বাইরে নেই। ধলেশ্বরী, ইছামতি, ব্র⊃2;পুত্র, মেঘনা এ চারটি প্রধান নদীই আমাদের মুন্সীগঞ্জের ভৌগলিক ভীত গড়ে দিয়েছে। এ নদীর  স্রোতে মুন্সীগঞ্জে পলি পরতো। সেই পলিতে প্রচুর পরিমানে ধান হতো। ধানই এক সময় মুন্সীগঞ্জের প্রধান ফসল ছিল। নদী, পুকুর, বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। ইলিশের প্রচুর চাহিদা ছিল মুন্সীগঞ্জের মানুষের কাছে। যা এখনো প্রচলিত আছে। তবে রুই, শোল, পুটি, শিং, কই, মাগুর, বোয়াল, পাবদা, চাপিলা, চেউয়া মাছ ছিল প্রাধান্য ছিল ব্যপক। গরু, ভেড়া- মহিষের মাংস খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।
 

মুন্সীগঞ্জের ভর্তা
মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন পাতার ভর্তা খাওয়া হতো তার সাথে খাওয়া হতো বিভিন্ন সুটকী মাছের ভর্তা। যার ঐতিহ্য এখনো রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলার মানুষ আজো তার স্বাদ গ্রহন করে আসছে। বেগুন, লাউ, কুমড়া, কচু, সীম সবজী হিসেবে খাওয়া হতো। দুধ, ডাবের পানি, আখের রস, তালের রস পানিয় হিসেবে ব্যবহার হতো। প্রাচীন কালে তালের রস দিয়ে তারি বানিয়ে নেশা করা হতো। মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরে প্রচুর কলার চাষ হতো। রামপালের কলার কথা আজো সবার মুখে মুখে শোভা পায়। যদিও তা এখন বিলুপ্তের দ্বারপ্রান্তে।
হতো মূলা নামক এক প্রকার সবজী চাষ। মুন্সীগঞ্জের গ্রামীন মানুষেরা বলে থাকে-‘‘রামপালের কলা আর মুন্সীগঞ্জের মূলা’’। চাপাকলা, সবরী কলা, কবরী কলা, অমৃত সাগর কলার জন্য এখনো মুন্সীগঞ্জে বিখ্যাত। খাওয়া হতো পিঠা ও গুড়ের তৈরী পায়েশ। বুটও বাদাম ভাজাও খাওয়া হতো। কলা পাতায় গরম ভাত, ঘি, পাতখির, মৌরাল মাছ ও পাট শাক খাওয়ার রীতি ছিল। মাটির বাসন, মাটির গøাস, মাটির পাতিল, পিতলের যাবতীয় বাসন-কোসনে রান্না ও খাবারের কাজ হতো।
 

মুন্সীগঞ্জের ঘরবাড়ি
প্রাচীন মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরে মানুষ কীভাবে কেমন করে গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করতো তা আজঅব্দি কোন পুস্তকে এখনো লেখা হয়নি। বা কোন চিত্র ফলকও আবিস্কার হয়নি।
ময়নামতি ও পাহাড়পুর চিত্র ফলক থেকে আমরা অনুমান করতে পারি। এছাড়া বাবা আদম শহীদ মসজিদ, টেঙ্গর মসজিদ, জোড়ারদেউল, বল্লালবাড়ি, ইদ্রাকপুর দূর্গ, রঘুরামপুর, রামপাল, নাটেশ্বর মাটির নিচে প্রাচীন যুগের পাঁকা বাড়ি ও দালান পাওয়া যায়। রাজবাড়ি-ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে হয়তো বা প্রাচীন যুগে পাঁকা ইমারত ছিল।কিন্তু প্রাচীন মুন্সীগঞ্জের সাধারন মানুষেরা মাটি, খড়, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বসবাসের জন্য ঘর তৈরী করতো। ১৯৭০ সালেও মুন্সীগঞ্জের গ্রাম গুলোতে শন, খড়ের ঘর ও বাশের খুটি দেখা যেত। ১৯৯০ সাল থেকে এ অঞ্চলে প্রচুর ঢেউটিনের ১৭,২১,২৫,৩০ বন্ধের ঘর দেখা যাচ্ছে। ইদানিং মুন্সীগঞ্জ শহরে ৫তলা, ৮তলা ও ১০তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। প্রাচীন মুন্সীগঞ্জে বাঁশ, শন ও খড়ের দু’চালা ঘরের সংখ্যা বেশী ছিল। শোবার জন্য হোগলা, পাটি, কাঁথা, পাটের চট ব্যবহার হতো। বালিশের ব্যবহারও ছিল। চকি, খাট ও পালঙ্ক ব্যবহার ছিল শোবার জন্য। মুন্সীগঞ্জ জেলায় রামপাল, বজ্রযোগিনী, কাজী কসবা, ফিরিঙ্গীবাজার, মিরকাদিম ও ইদ্রাকপুর প্রাচীন শহর এখানে ইটের ঘরবাড়ি ছিল।