সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বেঁচে আছেন আলোকিত মানুষ ফাদার ডক্টর র্জজ ম্যানুয়েল মতামত / 
জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সমাজে সভ্যতার যে বিকাশ ঘটে। তার জলন্ত প্রমান মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সহমর্মিতা। সব কিছু মিলিয়েই জ্ঞান অর্জনের পূর্ণতা। আর এসবের মাধ্যমেই আলোকিত মানুষ তাঁর সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়েই বিশ্বকে জয় করেন। ছড়িয়ে যান ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে নিজের অর্জিত সবটুকুই আলো। এসব মানুষ চাওয়া-পাওয়ার কোন হিসাব রাখেন না। মানুষের জন্য নীরবে কাজ করতেই পছন্দ করেন। মহান সৃষ্টি কর্তা মানুষকে দুটি জিনিসের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। একটি হলো মানুষের বাহ্যিক দেহ এবং অপরটি হলো আত্মা। নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের মঙ্গল সাধিত হওয়ার জন্য সৃজন সাধনা করে গেছেন উত্তর দিনাজপুরে এক প্রাণ পুরুষ। সেই প্রাণ পুরূষ হচ্ছেন ফাদার ডক্টর র্জজ ম্যানুয়েল।
তিনি তামিলনাডুর কন্যাকুমারীতে জন্ম গ্রহন করেন এবং সেখানেই বেড়ে উঠেন। তরুণ বয়সে ফাদার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং কলকাতায় মাদার ট্যারিজার মিশনারিজ অব চ্যারাটিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে রায়গঞ্জ মিশনে ফাদারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। ছোট বেলা থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য স্পৃহা তাঁর মাঝে কাজ করছিল। রায়গঞ্জ মিশনে থাকাকীলন সময় তাঁর ইচ্ছা ছিল অসহায় বয়স্ক মানুষদের জন্য বৃদ্ধা আশ্রম খোলার। এ ভাবনা থেকেই তিনি রায়গঞ্জ মিশনে ফাদারের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে, সুভাসনগর চোপড়ার কলাগাছ নামক স্থানের ৩১ নম্বর সড়কের পাশের এক নীর্জন পল্লীতে। সুখবিলাস ছেড়ে এখানে এসে তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে তিন বিঘা আবাদী জমি ক্রয় করেন। জমির কিছু অংশের উপর বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাদের থাকার জন্য পাকা ঘর তৈরী করেন। জমির বাকী অংশে চাষা-বাদ শুরু করেন। দারূণ এক নির্জন পরিবেশ। এ বৃদ্ধা আশ্রমের চত্তরে প্রবেশ করলে দেখা মিলে এ আলোকিত জ্ঞানী ও গুণী মানুষ ফাদার ডক্টর র্জজ ম্যানুয়েল’র। নিজের হাতে তৈরী ফুলের বাগান এবং অন্য পাশে সবজীর বাগান। নান্দনীক ও অপরূপ সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ বাগানটি। পুরো বৃদ্ধা আশ্রমটি দেখতে যেমন পরিপাটি তেমনি এখানকার প্রবীণগণও সেবার মানে খুশি। একেবারে সাদা-মাটা জীবন যাপন করতেন ফাদার। আপাত: দৃষ্টিতে দেখে কখনও মনে হত না যে তিনি একজন ডক্টরেট ডীগ্রীধারী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। গ্রামীন জীবন ছিল তাঁর খুব আপন। কখনও বাগান পরিস্কার করা আবার কখনও ঝোপ-জঙ্গল খেকে খড়ি কেটে আনা। এসব ছিল তাঁর নিত্য কাজের অংশ। সব সময় ছিল তাঁর চেষ্টা, আশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জীবনে কীভাবে হাসি ফোটানো যায়। এসব নিয়েই সদাই ব্যস্থ থাকতেন তিনি। স্থানীয়রাও তাঁকে সহযোগিতা করতেন কিন্তু অনেক সময় বেশ কিছু স্থানীয় বখাটেরা এ আশ্রমে নানাভাবে অত্যাচর ও হেনেস্তা করার চেষ্টা করতেন। এমনকী নোংরা দ্রব্যাদি গেটের সামনে রেখে আসতেন। তাতেও ফাদার বিচলিত হতেন না। ধীরে ধীরে এ বৃদ্ধা আশ্রম স্থানীয়সহ অনেক মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। প্রধান সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন রোববার সাহিত্য আড্ডার কবি ও সাংবাদিক সুশান্ত নন্দী। এভাবে অনেকেই এগিয়ে এসে ফাদারের এ ভালো কাজের পাশে দাঁড়ায়। ফাদারের বয়স বাড়তে থাকে এবং তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে পড়ে। এক বছর ধরে ডায়ালিসিস চলছিল। শারীরিক এ যন্ত্রনার মাঝেও গত ২০১৭খ্রি: ২মে তাঁর সাথে কথা হলে তিনি হাসিমুখে বলেন, ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এ যন্ত্রনা উপহার দেবার জন্যে। এ উপহার না পেলে আমি মানুষের যন্ত্রনা কী তা বুঝতে পারতাম না।
এ বৃদ্ধা আশ্রমে তিনি নিজে থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবাই নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। তিনি কখনও কারোর কাছ থেকে এ আশ্রম চালানোর জন্য অর্থ গ্রহন করতেন না। তবে কেউ যদি কিছু দিতে চাইতো তা খাদ্য কিনে দিত। সেটা তিনি গ্রহন করতেন। তিনি ৭অক্টোবর, ২০১৭খ্রি: মধ্যরাতে এক দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে ওই পল্লীতে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
তিনি রেখে গেছেন এ জনপদে তাঁর ভালোবাসা দিয়ে গাঁথা বৃদ্ধদের জন্য এ অভয় আশ্রম। নীর্জন এ মনোরোম পরিবেশে বৃদ্ধারা আজও সেই সেবা পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু নেই ফাদার, তিনি চলে গেছেন অনন্তলোকে চির নিদ্রায়। কত পূর্ণিমার রাত পার হয়েছে আর কত গোধুলি পার হয়েছে কিন্তু বৃদ্ধা আশ্রমে যে আজও গোধুলি চোখে পড়ে না। ফাদার চলে যাওয়ার এক বছর পার হয়েছে কিন্তু এখানকার বিষন্নতা আজও কাটিয়ে উঠে নাই আশ্রমে বসবাসরত বৃদ্ধদের। তারা নানা উদবিগ্নতায় দিনাতিপাত করছেন। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত এ ওল্ড এজ হোমের উদ্বিগ্নতা দূর করার জন্য এগিয়ে এসেছেন এবং দৃঢ়তার সাথে এটি পরিচালনা করছেন কলম যোদ্ধা নির্ভীক যুবক কবি ও সাংবাদিক সুশান্ত নন্দী। তাঁর সঙ্গে সহযোগিতায় রয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (উত্তর দিনাজপুরের) ইসলামপুরের খ্যাতনামা কবি ও গল্পকার নিশিকান্ত সিন্হাসহ আরো অনেকে।
নানা ফেরার দেশে চির নিদ্রায় শায়িত এ আলোকিত মানুষটি নিজের সবটুকু উজাড় করে,যে ভালোবাসা দিয়ে তৈরী করে গেছেন পরিবারে এবং সমাজে অবহেলিত অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আবাস স্থল। তা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করবে। প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর এ মহান ত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
লেখক: আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সাংবাদিক, গবেষক, সম্পাদক ও প্রকাশক।