Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

খাগড়াছড়ির হত্যাকান্ডে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রত্যাখ্যান, বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি

আধা বেলা সড়ক অবরোধ শান্তিপুর্ণভাবে পালিত, নিহতদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন খাগড়াছড়ি

আধা বেলা সড়ক অবরোধ শান্তিপুর্ণভাবে পালিত, নিহতদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বিজিবি সদর দপ্তর ও পুলিশ ফাঁড়ি মধ্যবর্তী পানছড়ি ষ্টেশন স্বনির্ভর বাজার মোড়ে প্রতিপক্ষে সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে ৭জন নিহতের ঘটনায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি তপন চাকমাসহ ৭ জনের মৃত্যুর প্রতিবাদে জেলায় আধা বেলা সড়ক অবরোধ শান্তিপুর্নভাবে পালিত হয়েছে। 

সোমবার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ তিনটি সংগঠন জেলার ৯টি উপজেলা অভ্যন্তরীন সড়কে বিভিন্ন জায়গায় টায়ার জালিয়ে ও গাছ ফেলে পিকেটিং করতে দেখা গেছে। দুরপাল্লা যানবাহন ছেড়ে আসা যাত্রীবাহি নৈশ কোচগুলো কড়া পুলিশি পাহাড়ায় গন্তব্য স্থলে পৌছে দেওয়া হয়েছে। ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-ভুক্ত চারটি সংগঠন খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর-পেরাছড়া হত্যাকান্ড তদন্তের জন্য খাগড়াছড়ির অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু ইউছুফ আলীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে সুষ্ঠ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

শহরে স্বর্নিভর এলাকায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশ রোববার রাতে মামলা রুজু করেছে। এ মামলায় ১৫/২০জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আধিপত্য বিস্তারের জেরে গত শনিবার সকালে খাগড়াছড়িতে স্বর্নিভর বাজারে সন্ত্রাসী হামলায় তিন পথচারীসহ সাত জন নিহতের ঘটনা প্রতিবাদে ডাকা সড়ক অবরোধের সমর্থনে জেলার শহরে পিকেটিং না থাকলেও দুর পাল্লা ও আভ্যন্তরীন সড়কে যানবাহন একেবার চলাচল বন্ধ রয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। তবে ঘটনার পর থেকে স্বর্নিভর বাজার এখনো বন্ধ রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ে ঈদের পূর্ব মহূর্তে সড়ক অবরোধের কারণে বিপাকে পড়েছে কোরবানী পশুর হাটে ক্রেতা, বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীসহ ঘরমুখ মানুষ। তবে দুপুরে পর থেকে অবরোধ না থাকায় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: শাহদাত হোসেন টিটু জানান, নিহতের পরিবারগুলোকে মামলা করার জন্য বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মামলা করতে রাজি না হওয়ায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৫/২০ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা করেছে। যার মামলা নং-১২, তারিখ: ১৯-০৮-২০১৮ইং। পোষ্ট মর্টেম শেষে ৭জন নিহতের লাশ পরিবারের কাছে ইতি মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। রোববার বিকেলে তাদের অন্তেষ্ট্রিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় এখনো কোন আটক নেই। প্রতিপক্ষের হামলায় হতাহতের ঘটনায় কোন পক্ষ মামলা না করায় শেষ পর্যন্ত পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করতে হল। ময়না তদন্তের পর তিনটি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও অপর তিনটি লাশ নিতে না আসায় ইউপিডিএফ (প্রসিত) গ্রুপ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি সভাপতি তপন চাকমা, এল্টন চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহ-সভাপতি পলাশ চাকমার লাশ খাগড়াছড়ি সদর থানার হেফাজতে রাখা হয়। পরে রোববার বিকেলে উত্তর খবংপুড়িয়া এলাকায় পুলিশ মোবাইল টিম নিজে গিয়ে খবং পুড়িয়ার পরিবারে কাছে হস্তান্তর করা হয় । 

অবরোধে ষ্পর্শকাতর এলাকায় পুলিশ, আমর্ড পুলিশ, সাদা পোষাকে গোয়েন্ডা কর্মী, আনসার বাহিনীসহ অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে কর্মী বাহিনীকে জ্বালাও-পোড়াও যে কোন ঘটনা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। সন্ত্রাসী হামলায় ৭নিহতের পর সন্ত্রাস নির্মূলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে খাগড়াছড়িতে রোববার বিকেল থেকে সহস্রাধিক সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনীর চিরুনী অভিযান চলছে। খাগড়াছড়ি জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। 

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্বর্নিভর ও পেরাছড়া এলাকায় শনিবার প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী হামলা ও ব্রাশ ফায়ারে ৭জনের মৃত্যুর ঘটনায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আতংক বিরাজ করছে সাধারন স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে। স্বর্নিভর বাজারের দোকানপাট আজও বন্ধ রয়েছে। তবে, বন্ধ থাকা খাগড়াছড়ি-পানছড়ি প্রধান সড়কে রোববার সকাল থেকে যানবাহন আংশিক চলাচল শুরু করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি উত্তরনে কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত ৫ সদস্যের তদন্ত টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

এদিকে একই ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান ইতি মধ্যে শুরু হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্বার, সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় রোববার থেকে খাগড়াছড়ি জেলা ব্যাপী যৌথ বাহিনী চিরুনী অভিযান শুরু হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে সেনা, পুলিশ, আমর্ড পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর রোববার বিকেল ২টা থেকে ১৫দিনব্যাপী অভিযান শুরু করা হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার আটক নেই ও প্রাণহানির ঘটনায় সদর থানা মামলা রুজু করা হয়েছে। 

সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত ৭জনের মধ্যে ৪জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি সংগঠনগুলোর তিন নেতার লাশ নিতে পরিবারের কেউ থানায় না আসায় রোববার বিকেলে পুলিশ কড়া পাহারায় দক্ষিন খবংপুড়িয়া চেঙ্গী নদীর পাড়ে পৌছিয়ে দেয়া হয়। সেখানে পরিবারের সদস্য ও দলীয় লোকজন মরদেহ গ্রহন করে চেঙ্গী ওপারে নিয়ে স্থানীয় স্বশানে দাহক্রিয়া সম্পন্ন করে। মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমা ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী রুপম চাকমার মরদেহ খবংপুড়িয়া মহাশ্বশানে, টেক্সটাইল প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমার মরদেহ পানছড়ি উপজেলা উগলছড়ি স্বশানে এবং বৃদ্ধ শন কুমার চাকমার মরদেহ পেরাছড়া মহাস্বশান এলাকায় দাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আলী আহম্মদ খান জানান, ৭জন নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে আধাবেলা অবরোধ শান্তিপুর্ন ভাবে পালিত হয়েছে। দুরপাল্লা যাত্রীবাহি বাসগুলো নির্দ্দিষ্ট স্থানে পোচ্ছে দেওয়া হয়েছে। যৌথ অভিযানে অবৈধ অস্ত্রধারী, মাদক, সন্ত্রাসীদের আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শহরের গুরুত্বপুর্ণ স্থানে চেক পোষ্ট বসিয়ে তল্লাসী কার্যক্রম চলছে। পুলিশ সুপার মো: আলী আহমেদ খান বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আমর্ড পুলিশ অভিযান চলমান থাকবে। যত দিন সন্ত্রাস নির্মল করা সম্ভব হবে না ততদিন অভিযান অব্যাহত থাকবে। পুলিশ, আর্মড পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সমন্বয়ে এই যৌথ অভিযান চলবে পুরো ১৫দিন জুড়ে। পরে প্রয়োজনে অভিযানের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে। 

খাগড়াছড়ির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মো: শহিদুল ইসলাম শনিবার সন্ধ্যায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। জেলা প্রশাসকসহ এ কমিটি রোববার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: ইউসুফ আলীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কড়া পুলিশ পাহাড়ায় জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে শনি-রোববার বিকেলে ও সন্ধ্যায় নিহতদের লাশ ময়না তদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হন্তান্তর করা পর দাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। গত শনিবার প্রান কেন্দ্র শহরের স্বর্নিভর এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৭জন নিহত ও ১১জন আহত হবার ঘটনা তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসন। জেলা ম্যাজিস্টেট মো: শহিদুল ইসলাম শনিবার রাতে ৫সদস্য বিশিষ্ট পুর্ন এই কমিটি গঠন করেন। তারা হলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: আবু ইউছুফ আলীকে আহবায়ক। কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে আছেন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সামছুল তাবরীজ। সদস্য হিসেবে রয়েছে অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার মো: এসএম সালাহ উদ্দিন, খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ড: নয়নময় ত্রিপুরা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মো: জসিম উদ্দিন। কমিটিকে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-ভুক্ত চারটি সংগঠন খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর-পেরাছড়া হত্যাকান্ড তদন্তের জন্য খাগড়াছড়ির অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আবু ইউছুফ আলীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে সুষ্ঠ,স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে। মঙ্গলবার ২০ আগষ্ট ২০১৮ গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিনয়ন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা ও ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সভাপতি সচিব চাকমা এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানান।

তারা বলেন, ‘যে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের পাহারার মধ্যে জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ বাজার স্বনির্ভরে এত বড়হত্যা যজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে সে প্রশাসনের পক্ষে নিরপেক্ষ ভাবে এ ঘটনার তদন্ত করা কখনোই সম্ভব নয়।’ প্রশাসনের এই পর্বত-প্রমাণ ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য এবং ঘটনার সাথে জড়িত সেনাবাহিনীর একাংশের মদদপুষ্ট পিসিজেএসএস সংস্কারবাদী সন্ত্রাসীদের রক্ষা করতে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন এবং বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনের কোন মহলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতাছাড়া শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে এসে ১০-১২ জন সন্ত্রাসীর পক্ষে ২৫ মিনিট ধরে এভাবে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিজিবি পোস্টের পাশ দিয়ে হেঁটে পালিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়, আর তাই প্রশাসন কোন ভাবে এ হত্যাকান্ডের দায় এড়াতে পারে না।’ 

খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর-পেরাছড়া হত্যাকান্ডকে ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত একটি পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ কেবল ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজানে সংঘটিত ইসলামী জঙ্গীদের হামলার সাথে তুলনীয়।’ হামলার ২ দিন পরও জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতার না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে চার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, “সন্ত্রাসীরা খাগড়াছড়ি শহরে তাদের আস্তানা মহাজনপাড়া, মধুপুর, তেঁতুলতলা ও খাগড়াপুরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ তাদের গ্রেফতার না করে উল্টো ইউপিডিএফ যাতে ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য পানছড়ি-খাগড়াছড়ি প্রধান সড়কে স্বনির্ভর থেকে দেওয়ানপাড়া পর্যন্ত সেনাটহল জোরদার ও চেক পোষ্ট করেছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অশান্ত ও অরাজক পরিস্থিতির জন্য সেনাবাহিনীর উগ্রবাদী অংশকে দায়ী করে তারা বলেন, ‘যতদিন পিসিজেএসএস-সংস্কারবাদী সন্ত্রাসীদের দিয়ে ইউপিডিএফএর নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নীতি পরিহার করা হবে না, ততদিন পাহাড়ে এ ধরনের হামলা, রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’

নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে স্বনির্ভর-পেরাছড়া হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত পিসিজেএসএস-সংস্কারবাদী সদস্যদের গ্রেফতার ও শাস্তি, হামলা প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য দায়ি পুলিশ-বিজিবির সদস্য ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পিসিজেএসএস-সংস্কারবাদী সন্ত্রাসীদের মদদদান বন্ধের দাবি জানান। গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম’র কেন্দ্রীয় কমিটি সহ-সাধারণ সম্পাদক বরুন চাকমা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা: নয়নময় ত্রিপুরা জানান, নিহত ব্যক্তিদের ময়না তদন্ত শেষে শনি-রোববার সন্ধ্যায় পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদিকে শনিবার ময়না তদন্তের পর চারটি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও অপর তিনটি লাশ নিতে না আসায় রোববার বিকেলে সদর থানার মোবাইল পুলিশ টিম উত্তর খবং পুড়িয়া এলাকায় দিয়ে আসলে আত্মীয়স্বজন ও ইউপিডিএফ’র সহকর্মীদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে। পরে ইউপিডিএফ’র সংগঠক অংগ্য মারমা, গনতান্ত্রিক যুবফোরামের রতন স্মৃতি চাকমা, পিসিপির অমল ত্রিপুরাসহ অন্যান্যসহকর্মীরা হাসপাতাল থেকে আনা নিহত কফিন গ্রহন করে। নিহত সক্রিয় ৩কর্মীকে দলীয় পতাকা মোড়ানো কফিনে ফুল দিয়ে গার্ড অব অনার মধ্য দিয়ে যথাযথ সম্মান প্রর্দশনে শেষ শ্রদ্ধার পর রোববার বিকেলে চেংগী নদী তীরবর্তী উত্তর খবং পুড়িয়া নির্দ্দিষ্ট মহাশ^শানে দাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এর আগে জেলা সদর হাসপাতাল থেকে সদর থানা হেফাজতে রাখা ছিল ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি শাখার সভাপতি তপন চাকমা, এল্টন চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহ-সভাপতি পলাশ চাকমার লাশ। 

অপরদিকে পাহাড়ে বিবদমান পাহাড়ি সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তার লড়াই, চাঁদাবাজি, খুন-অপহরণ এখন নিত্য দিনের ঘটনা। এ লড়াইয়ে চলতি বছরে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৩২জন। পাহাড়ে বিবদমান  সংঘাতে ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় সচেতন মহল উদ্বেগ-উৎকন্ঠা প্রকাশ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী। এ নির্মম হত্যাকান্ডের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কয়েকশ সন্ত্রাসীর হাতে জেলার প্রায় ৬ লাখ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। এর অবসান হওয়া দরকার। পাহাড়ে চলমান সংঘাত-সংঘর্ষের অবসান ও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায় এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ।

অন্যদিকে টেক্সটাইল প্রকৌশলী ধীরাজ চাকমার অকাল মৃত্যু। এ ঈদের বন্ধেই তার বিয়ে হওয়ার কথা। পাত্রী ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু পরিবারের সে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তদের একটি বুলেট। কথাগুলো বিলাপ বলছিল ধীরাজ চাকমা মা ফুল কুমারী চাকমা।

ধীরাজ চাকমার বাড়ী পানছড়ি উপজেলা উল্টাছড়ির উগলছড়ি গ্রামের বাসিন্দা। কর্মস্থল ছিল কুষ্টিয়ায়। শুক্রবার রাতে নৈশকোচে করে ঢাকা হয়ে বাড়ী ফিরছিলেন। দীর্ঘদিন পর বাড়ী ফিরছে তাই মায়ের জন্য একটি মোবাইল ফোন সেট ও মিষ্টি কিনেছেন ধীরাজ চাকমা। ভোর পৌনে ৭টার দিকে মাটিরাঙা পৌছে মায়ের সাথে কথা হয়েছে। মাকে বলেছিল, বাসা পৌছে নাস্তা করবো। হয়তো আর এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যেত। কিন্তু না, তার বিধি বাম। ধীরাজ ফিরেছে নিঠর লাশ হয়ে। শনিবার বিকেলে খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালের সামনে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন, ধীরাজ চাকমার মা ফুল কুমারী চাকমা। শনিবার সকালে স্বর্নিভর বাজারে পড়ে ছিল ধীরাজ চাকমার নিথর দেহ। পাশে পড়ে ছিল মিষ্টি, মোবাইল ফোন সেটের প্যাকেট ও ব্যাগ।

ফুল কুমারী চাকমা জানান, ধীরাজ চাকমা ছিল শান্ত স্বভাবে আমার আদরে একমাত্র ছেলে। ছিল মোটামুটি মেধাবী। বিড়ি-সিগারেটসহ কোন ধরনের নেশা পান করতো না। ঘটনার দিন জানা যায়, নৈশ কোচ থেকে চেংগী স্কোয়ারে নেমে শহরে টমটমে করে স্বর্নিভর বাজারে পৌছে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ধীরাজ চাকমা। আকস্মিভাবে সন্ত্রাসীদের ভারী অস্ত্রের গর্জনে কেঁপে উঠে পুরো স্বর্নিভর এলাকা। কিছু বুঝার আগেই সন্ত্রাসীদের একটি বুলেট বিদ্ধ হয় ধীরাজ চাকমার শরীরে। নিভে যায় ধীরাজের তরতাজা প্রাণ প্রদীপ। শেষ হয়ে যায় তার পরিবারের সব স্বপ্ন।

ইতিপূর্বেও পাহাড়ে আঞ্চলিক রাজনীতির শিকার হয়েছে বহু মেধাবী মানুষ। খালি হয়েছে বহু মায়ের বুক। তার পর ফুল কুমারী চাকমার বক্তব্য আমি ছেলের হত্যা বিচার চাই না। তবে রাষ্ট্রের কাছে গ্যারান্টি চায় আর কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয়। বন্ধ হোক মানুষ মারার অপরাজনীতি। ভালমানের গুনবর্তী চাইতে শুন্য গুয়াল ভাল বলে মানবিক বিবেকবান ব্যক্তি ও সচেতন মহলের এগিয়ে আসার আহবান জানান।

অপরদিকে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি আন্ত: প্রধান সড়কে ভাইবোনছাড়া সাব-জোন আর্মি ক্যাম্প, নাকশাতলী অস্থায়ী চেক পোষ্ট, স্বনির্ভর বাজার পাশর্^বর্তী বিজিবি দুই পার্শে ২টি চেক পোষ্ট বসিয়ে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তবে সাধারন যাত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সাবেক সদস্য মিন্টু বিকাশ চাকমা জানান, রোববার হোন্ডা যোগে পানছড়ি থেকে আসার পথে ক্যাপ্টেন পর্যায় আর্মি অফিসার মিথ্যা ফায়ারিং কথা বলে নাকশাতলী অস্থায়ী আর্মি চেক পোষ্টে দুই ঘন্টাব্যাপী আটকিয়ে অন্যায়ভাবে রাখানো হয়েছে এবং ব্যাপক তল্লাসী করার হয়রানি অভিযোগ করেন। এই সব নিরাপত্তাবাহিনী মিথ্যা অজুহাত ব্যক্তিদের তীব্র নিন্দা জানান ।

উল্লেখ্য, শনিবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে হঠাৎ একদল অজ্ঞাত সশস্ত্র দুর্বৃত্ত ভারী অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের নেতা কর্মীদের উপর হামলা ব্রাশ ফায়ার চালালে ৭জন নিহত ও ১১জন আহত হয়। আধিপত্য বিস্তারের জেরে শনিবার(১৮ আগস্ট) সকালে খাগড়াছড়ির স্বর্নিভর বাজারে বিবদমান দুই পাহাড়ি গ্রুপের মধ্যে প্রতিপক্ষের বন্দুক ব্রাশ ফায়ার হামলায় ৭জন নিহত ও বেশ কয়েকজনসহ ১১আহত হয়। বিজিবি সেক্টর ও পুলিশ বক্স ফাড়ি ৩০গজের মধ্যবর্তী স্থানে প্রান কেন্দ্র শহরের স্বর্নিভর বাজার এলাকায় বিবাদমান প্রতিপক্ষে সন্ত্রাসী গ্রুপের আতর্কিত বন্দুক হামলায় হতাহতের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর ও পেরাছড়ায় ইউপিডিএফ-ভুক্ত সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপর সেনা-মদদ পুষ্টজুম্ম/পাহাড়ি রাজাকার পিসিজেএসএস সংস্কারবাদী-নব্য মুখোশ বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, হিল উইমেন্স ফেডারেশন খাগড়াছড়ি জেলা শাখা সোমবার আধা বেলা খাগড়াছড়ি জেলায় শান্তিপূর্ণ সড়ক অবরোধ পালনে ডাক দেয়। আগামী ২২আগস্ট মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ উৎসব ও সরকারী ছুটির কথা বিবেচনা করে এই সংক্ষিপ্ত অবরোধের ঘোষণা দেয়া হয়। অবরোধের সময় এম্বুলেন্স, রোগী বহনকারী যান, ফায়ার সার্ভিস, জরুরী বিদ্যুৎ-পানি ও ঔষধ সরবরাহকারী গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত। জেলার সকল যানবাহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট কলকে উক্ত শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসুচিতে সহযোগিতা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। পিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখা দপ্তর সম্পাদক সমর চাকমা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। 

এলাকার আধিপত্য বিস্তারের জেরে খাগড়াছড়ি স্বর্নিভর বাজারে বিবাদমান প্রতিপক্ষের গ্রুপের ব্রাশ ফায়ারের ভারী অস্ত্রের গুলির আওয়াজে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। আতংকে এলাকা ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে এখনও রক্তের দাগ রাস্তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিহত অধিকাংশ আত্মীয় স্বজনদের মাঝে আহাজারী করতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি জেলা শহর জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মুর্হুতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে পানছড়ি অভ্যন্তরীন সড়ক যোগাযোগ অনিদির্ষ্টভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্কুল পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রী, সরকারী চাকুরীজীবি ও সাধারন যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। ষ্পর্শকাতর এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবি তহল জোরদার ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।