Opu Hasnat

আজ ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ২০২৪,

ঝালকাঠিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নেশাদ্রব্য বিক্রি, মাদকাসক্তদের ভরসাই ফার্মেসী ঝালকাঠি

ঝালকাঠিতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নেশাদ্রব্য বিক্রি, মাদকাসক্তদের ভরসাই ফার্মেসী

ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ঝালকাঠি জেলার যত্রতত্র ফার্মেসি খুলে চলছে ওষুধ কেনা-বেচার ব্যবসা। রেজিস্টারকৃত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ছাড়াই মাদকাসক্তরা চাহিবা মাত্রই অনেক ফার্মেসীতে বিক্রি হচ্ছে নেশাজাতীয় ঔষধ। 

অনুসন্ধানে জানাগেছে, জেলা সদরসহ ৪টি উপজেলা ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ৪ সহস্রাধিক ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। এসব ফার্মেসির বেশির ভাগ নেই ফার্মাসিস্ট সনদ। অনেকের ড্রাগ লাইসেন্সটি পর্যন্ত নেই। ওষুধ প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এসব ফার্মেসিতে যেমন মিলছে অবৈধ ওষুধ, তেমনি সেলফ প্রেসক্রিপশনে নিম্নমানের ও ভুল ওষুধ বিক্রি করছে বিক্রেতারা। ফলে একদিকে যেমন ওষুধ ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা, সেই সঙ্গে সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনাও। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪০ অনুসারে ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই ওই ব্যক্তিকে কমপক্ষে ছয় মাসের ফার্মাসিস্ট কোর্স করে সনদ সংগ্রহ করতে হবে। পরে সংশ্লিষ্ট ড্রাগ সুপারের কার্যালয়ে ফার্মাসিস্ট সনদ জমা দিয়ে ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে। ড্রাগ সুপার আবেদন যাচাইয়ের পর ড্রাগ লাইসেন্স দিলেই কেবল ওষুধের ব্যবসা বা ফার্মেসি দেওয়া যাবে। এদিকে জেলায় কী পরিমাণ ফার্মেসি রয়েছে, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতিতেও। তবে ঝালকাঠি জেলায় ৪ সহস্রাধিক ফার্মেসীর মধ্যে ড্রাগ লাইসেন্স রয়েছে মোট ৫শতাধিক। 

সরেজমিনে বেশ কিছু ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হাতে গোনা মাত্র ১০-১২ জন ওষুধ ব্যবসায়ীর কেবল ফার্মাসিস্ট সনদ রয়েছে। অন্যদের কারোরই মূলত ওই সনদ নেই। তবে প্রায় প্রত্যেকেরই ড্রাগ লাইসেন্স রয়েছে। আর এসব ড্রাগ লাইসেন্সে উল্লিখিত ফার্মাসিস্টের নাম কেবল কাগজেই আছে, বাস্তবে অনেকেই ড্রাগ লাইসেন্সে উল্লিখিত ফার্মাসিস্টকে দেখাতে পারেনি। স্বাধীন মেডিকেল হলের ড্রাগ ও ফার্মাসিস্ট উভয় সনদ মালিকের নামে। অথচ দোকান পরিচালনা করছেন কর্মচারীরা। কর্মচারী পলাশ বলেন, “মালিক কোয়েল আমার বন্ধু, সে ক্যাশে বসে এবং আমিই এ দোকান পরিচালনা করছি।” একই ধরনের চিত্র সকল ফার্মেসি গুলোর। আবার অনেকে ড্রাগ লাইসেন্স কিনে আদালতের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে। এমন সংখ্যাও শতাধিক। কিছু ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট সনদ তো দূরের কথা, ড্রাগ লাইসেন্সটি পর্যন্ত নেই। অধিক মুনাফার লোভে ওষুধ বিক্রেতারা কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই চাহিবা মাত্রই বিক্রি করছে নেশাজাতীয় দ্রব্য। বয়স কিংবা প্রয়োজন না দেখেই শুধু তারা টাকাকে দেখছে বলে অভিযোগ রয়েছে।  

গোরস্থান রোডস্থ জনৈক হুমায়ুন কবীর বাদল অভিযোগ করে বলেন, প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। এছাড়াও নেশাজাতীয় দ্রব্য প্যাথেডিন মরফিন বিক্রি করছে অহরহ। ৭০/৮০ টাকা দামের একটি ইনজেকশন বিক্রি করছে ২৫০ থেকে ৩শ টাকায়। যাতে করে আঙুল ফুলে কলাগাছ নয় তাল গাছ হয়ে যাচ্ছে ওষুধ বিক্রেতাদের। এভাবে শহরের আনাচে-কানাচে অনেক ফার্মেসীতেই অবৈধ ও নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রি করছে। উঠতি বয়সী কিশোররাই এসব নেশাজাতীয় দ্রব্যের বেশির ভাগ ক্রেতা। বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে পেথিডিন, ডায়াজিপাম, ক্লোবাজমসহ ড্রাগ নেওয়ার জন্য বিক্রয় নিষিদ্ধ দেশি-বিদেশি নানা ওষুধ পাওয়া যায়। তবে একটু বেশি দামে এসব ওষুধ কিনতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের এক সচেতন সুশীল ব্যক্তি জানান, পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে তৎপর থাকায় বর্তমানে ফার্মেসীতেই ভর করছে মাদকাসক্তরা। অল্পদামে নেশাজাতীয় দ্রব্য হাতের নাগালে কোন প্রেসক্রিপশন বা কৈফিয়ত ছাড়াই ফার্মেসীর মালিক’র কাছ থেকে কিনে নিয়ে নেশার ঘাটতি পুরণ করছে। এমন অবস্থায় ছদ্মবেশে প্রশাসনের লোকজন যদি তৎপরতা চালায় তাহলে এ ধরণের অপকর্মও অনেকটা কমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝালকাঠির অনেকেই সাত-আট বছর আগে ঢাকা ও বরিশাল ড্রাগ সুপারের কার্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ড্রাগ লাইসেন্স সংগ্রহ করেছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে বরিশাল ড্রাগ সুপারের কার্যালয় থেকে এক-দেড় লাখ টাকায় ফার্মাসিস্ট সনদ ছাড়াই ড্রাগ লাইসেন্স সংগ্রহ করা যায়।  সচেতন অভিভাবকরা বলেন, একজন ফার্মাসিস্ট ছাড়া কোনোমতেই ওষুধের ব্যবসা চলা উচিত নয়। ড্রাগ সুপার ভুল করেও কোনোদিন ওষুধ ব্যবসার খোঁজখবর রাখেন না। ফলে যা ঘটা উচিত, তা-ই ঘটছে। ওষুধের মতো স্পর্শকাতর ব্যবসায় অবশ্যই সরকারের আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা উচিত। প্রশিক্ষিত ছাড়া এ ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ নেই। অথচ বাস্তবতা এই যে, প্রয়োজনীয় আইন থাকলেও মাঠ পর্যায়ে এর প্রয়োগ নেই। তাই এর কুফল ভোগ করছে সাধারণ নাগরিকরা। 

জেলা কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকট মুন্সি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ওষুধ ব্যবসায় আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা বরিশাল ড্রাগ সুপার বিভাগ এবং ওষুধ প্রশাসন দেখভাল করবেন। আমাদের সংগঠনে যারা আছে তাদের সবারই কাগজপত্র আছে। যখন সরকার কোন নীতিমাল করে যেটা সাধারণ ওষুধ ব্যবসায়ীদের সমস্যা হয়, তখন আমাদের কাছে আসে উত্তরণের জন্য। সিভিল সার্জন ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার বলেন, মূলত ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়নে সরকারের ওষুধ প্রশাসন বিভাগ কাজ করে থাকে। একজন ওষুধ পরিদর্শক ওষুধ ব্যবসা দেখাশোনা করার দায়িত্বে রয়েছেন। ঝালকাঠিতে ওষুধ ব্যবসার এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ওষুধ প্রশাসনকে জানানোর আশ্বাস দেন। এছাড়াও ফার্মেসি মালিকদের নিয়ে সচেতনতা মূলক সেমিনার করা জন্য পরবর্তীতে যিনি দায়িত্ব পালন করবেন তাকে পরামর্শ দেবার কথাও বলেন তিনি।