Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

ছয় র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে লিমন হত্যাচেষ্টা মামলা তদন্ত করবে পিবিআই ঝালকাঠি

ছয় র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে লিমন হত্যাচেষ্টা মামলা তদন্ত করবে পিবিআই

র‌্যাব ৮ এর ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে ঝালকাঠির রাজাপুরের লিমন হোসেন হত্যাচেষ্টা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বরিশালকে (পিবিআই) তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। রবিবার দুপুরে ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক মো. সেলিম রেজা এ আদেশ প্রদান করেন। ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ লিমনের মা হেনোয়রা বেগম ঝালকাঠির জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন দায়ের করেছিলেন। ৫ বছরে ৪২ বার এ রিভিশনের শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচজন জেলা ও দায়রা জজ এবং দুইজন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রিভিশনের শুনানি গ্রহণ করেন। সপ্তম বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এসকেএম তোফায়েল হাসান গত ১ এপ্রিল রিভিশনের সর্বশেষ শুনানি শেষে রিভিশন মঞ্জুর করেন। মামলার নথি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে পৌছার পরে রবিবার দুপুরে লিমনের মা হেনোয়রা বেগমের জবানবন্দী গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারক। যদিও হেনোয়রা বেগমের আইনজীবীরা আসামীদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ অথবা বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ প্রার্থনা করেছিল। আদালতের তদন্তের আদেশের ফলে বরিশাল র‌্যাব ৮ এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমানসহ ছয় র‌্যাব সদস্যর বিরুদ্ধে লিমন হত্যাচেষ্টা মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হলো।

লিমনের মায়ের আইনজীবী মো. আককাস সিকদার এবং মামলার নথিসূত্রে জানা যায় , ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে হতদরিদ্র কলেজ ছাত্র লিমন হোসেন র‌্যাব সদস্যদের কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ লিমনকে সন্ত্রাসী সাজিয়ে র‌্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান বাদী হয়ে কলেজ ছাত্র লিমন হোসেন ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরসেদ জোমাদ্দার এবং তার সহযোগিসহ আট জনের নামে দুটি মামলা দায়ের করে। এর একটি অস্ত্র আইনে এবং অপরটি সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগে। গুরুতর আহত লিমনকে ভর্তি করা হয় বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ যথাযথ চিকিৎসার অভাবে লিমনের বাম পা হাটু থেকে কেটে ফেলা হয়।

এ ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে বরিশাল র‌্যাব-৮ এর ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে ছেলে লিমনকে গুলি করে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাহানের আদালতে একটি নালিশী মামলা দায়ের করেন। আদালতের নিদেশের ১৬ দিন পর ২৬ এপ্রিল রাজাপুর থানায় র‌্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমানসহ ছয় জনের নামে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। অন্য আসামীরা হল কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক শ্রী প্রল্হাদ চন্দ্র এবং সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাস।

পুলিশ ওই মামলায় ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট র‌্যাব সদস্যদের নির্দোষ দাবী করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। লিমনের মা হেনোয়রা বেগম পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট নারাজী দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নারাজী আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারক মো. শাহীদুল ইসলাম। এ আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন লিমনের মা। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচজন জেলা ও দায়রা জজ ২৬ বার রিভিশনের শুনানি গ্রহণ করেন এবং কোন আদেশ না দিয়ে অধিকতর শুনানির জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করেন। ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট থেকে ১০১৮ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ১৬ বার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৪২ তম শুনানি শেষে গত ০১ এপ্রিল আদালত  র‌্যাবের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করেন।

লিমনের মায়ের আইনজীবী আক্কাস সিকদার বলেন, জজ কোর্টে রিভিশন মঞ্জুর হওয়ার পরে  আমলী আদালত পিবিআই’কে তদন্তের আদেশ দেওয়ায় লিমন হত্যাচেষ্টায় র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হল। 

উল্লেখ্য লিমনসহ আট জনের বিরুদ্ধে র‌্যাব অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগে যে দুটি মামলা দায়ের করেছিল ওই মামলা থেকে সরকার লিমনের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ২০১৩ সালের ১০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মিজানুর রহমান ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক এবং পাবলিক প্রসিকিউটরকে লিমনের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য আদেশ জারি করেন। এ আদেশ ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ঝালকাঠি জেলা জজ ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করা হয়। পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল মান্নান রসুলের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২ এর বিচারক কিরণ শংকর হালদার  ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই অস্ত্র মামলার দায় থেকে লিমন হোসেনকে অব্যাহতির আদেশ দেন। ঝালকাঠির চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু শামীম আজাদ সরকারের একই সিদ্ধান্তে সরকারি কাজে বাধা দানের মামলা থেকে লিমনকে অব্যাহতি দেন ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর। 

অপরদিকে যে শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরসেদ জোমাদ্দারকে ধরতে গিয়ে লিমনকে গুলি করেছিল র‌্যাব সদস্যরা সেই মোরসেদ জমাদ্দারসহ অপর সাত আসামী র‌্যাবের দায়ের করা অস্ত্র মামলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ৪ আদালত থেকে ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এবং সরকারি কাজে বাধা দানের মামলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে গত ২৯ মার্চ তারিখ বেকসুর খালাশ যায়। রিভিশনের শুনানীতে লিমনের মায়ের আইনজীবীরা এ বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেছিলেন।

এদিকে গুলিবিদ্ধ লিমনের একটি পা কেটে ফেলার পরে ২০১১ সালের ৯ মে হাইকোর্ট লিমনের জামিন মঞ্জুর করে। লিমন জামিনে মুক্ত হওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষ লিমনকে আর্থিক সাহায়তা করে। ঢাকার সাভারের সিডিডি নামের একটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠান লিমনকে একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেয়। এই নকল পায়ে ভর করে লেখা পড়া করে ২০১৩ সালে লিমন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। একই বছর লিমন ডা. জাফরউল্লাহর সহযোগিতায় সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্সে ভর্তি হন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে লিমন এলএলবি অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে লিমন কুস্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলএম কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। 

মুঠোফোনে লিমন হোসেন বলেন, র‌্যাব আমাকে গুলি করে শুধু পঙ্গুই করেনি, আমাকে সন্ত্রাসী বানানোর জন্য নানা রকম কারসাজি করেছে। পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে আমার মায়ের দায়ের করা মামলা আবার চালু হয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি একদিন র‌্যাবের ওই সদস্যদেরও আদালতে বিচার হবে।

লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বলেন, সাত বছর পর্যন্ত আমি আমার ছেলেকে গুলি করে পঙ্গু করার বিচার দাবী করে আসছি।  আদালত আমার রিভিশন গ্রহণ করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত হয় আমার অভিযোগ সত্য।