দখল দূষণ আর নাব্যতা সংকটে ধুকছে নবগঙ্গা নড়াইল /  বিশেষ সংবাদ / 
দখল, দূষণ আর নাব্যতা সংকটে পড়ে নবগঙ্গা নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। স্নিগ্ধ, স্রোতস্বিণী নবগঙ্গা নদীর সেই জৌলুস আর নেই। নেই তার তর্জন-গর্জন। নবগঙ্গা শুকিয়ে যাওয়ায় এখন সরু খালে পরিনত হয়েছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে ওঠা চরে চলছে ধান ও পাটের চাষাবাদ। দেশের আইন-কানুন নবগঙ্গার জন্য কার্যকর হয় না। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে নবগঙ্গা ধুকছে। মৃতপ্রায় নদীর তালিকায় স্থান পেয়েছে এককালের প্রমত্বা নবগঙ্গা নদী।
চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা মোহনা হতে শুরু হয়ে ঝিনাইদহ ও মাগুরা হয়ে নড়াইলের ওপর দিয়ে লোহাগড়ার শেষ প্রান্ত মহাজন বাজারে মধুমতি নদীতে মিশেছে নবগঙ্গা। নবগঙ্গার মোট দৈর্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। মাগুরা থেকে প্রবাহমান হয়ে তৎকালীন নড়াইল জেলার বৃহৎ নলদী পরগনায় মিঠাপুরের মধ্যে দিয়ে গাঢ় নীল রংয়ের পানির নবগঙ্গা নদী প্রবাহিত হয়। নলদী-লোহাগড়া হয়ে একমুখ মধুমতির সাথে এবং আরেক মুখ বড়দিয়া কালিয়া হয়ে চিত্রার সাথে মিশে প্রবাহমান নবগঙ্গা একসময়ে এই অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুখের সাথী হয়েই ছিলো। কালে কালে মধুমতি নদীর চরে মূলধারা লোহাগড়া ঈদগাহের পেছনে মরে যাওয়ায় গড়ে ওঠে বর্তমান লোহাগড়া বাজার। চরপড়া নবগঙ্গা নদী ঈদগাহের সামনে দিয়ে গতি পরিবর্তন করে বানকানা নদীর সাথে মিশে মলিকপুরের মধ্যে দিয়ে দিঘলিয়া বড়দিয়া হয়ে কালিয়ার মধ্য দিয়ে খুলনার গাজিরহাটে চিত্রার সাথে মিশেছে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে) এর জন্য নদীর উৎসমুখে মাগুরাতে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানি প্রবাহ কমে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের অন্যান্য সব নদীর মতো নবগঙ্গাও মরে যেতে থাকে। নাব্যতা সংকটের কারণে নবগঙ্গার নৌ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে এক যুগ আগেই।
বিভিন্ন সূত্রে যানা গেছে, ইংরেজ আমলে বাংলা ১২’শ সালে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে ওয়ারেন্ট হেষ্টিংস এর রাজত্বের সময়ে লক্ষীপাশা বন্দর গড়ে ওঠে। নদীর পাড়ে নলদী পরগনা ছিলো জেলার প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র। নলদী পরগনা থেকেই জমিজমার হিসাব খাজনা আর নড়াইলের রাজত্ব চালাতেন ইংরেজ বণিকেরা। এরও আগে নলদী পরগনা কে গাজীর মোকাম বলা হতো(গাজী-কালু চম্পবতীর নামানুসারে) আশির দশকেও নবগঙ্গা নদীতে অসংখ্য লঞ্চ চলতো এবং পাল তোলা নৌকায় গুন টেনে পণ্য আনয়ন করতেন ব্যবসায়ীরা। দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য মানুষজন নদী পথে ঢাকা-খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করতেন রোগী নিয়ে। নদীপাড়ের টোনা, বড়দিয়া, মহাজন, দিঘলিয়া, এড়েন্দা, লক্ষীপাশা, ব্রাহ্মনডাঙ্গা, নলদী, মিঠাপুর বন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যের কারনে নদীপাড়ের গ্রাম-গঞ্জ গুলো জমজমাট হয়েছিলো সে সময়। নাব্যতা সংকট ও কালের বিবর্তনে নবগঙ্গা নদীর সেই জৌলুস আর নেই। নেই তার আগ্রাসী রূপ।
একসময় নবগঙ্গা নদী দিয়ে ঘাটে ঘাটে স্ট্রিমার চলতো, তখন কোলকাতা থেকে স্টীমার নিয়ে বণিকেরা খুলনা হয়ে নড়াইলে আসতেন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে লোক আর পসরা নিয়ে। সে সব এখন কেবলই স্মৃতি। কালের আবর্তে নবগঙ্গা নদী তার রূপ যৌবন সবই হারিয়েছে। তবে তার জন্য যতটা প্রাকৃতিক কারন দায়ী, তার চেয়ে মানুষের তৈরী কারন অনেক বেশী দায়ী বলে মনে করেন নদী প্রেমিক মানুষেরা।
গত ৩৫ বছরের মধ্যে সরকারি নানা প্রকল্প আর এলাকার সুবিধাবাদী মানুষের ক্ষপ্পরে পড়ে সরু থেকে সরু হতে থাকে এক সময়ের স্রোতস্বিনী নবগঙ্গা। বর্তমানে মহাজন, লক্ষীপাশা, নলদী, মিঠাপুর বাজার এলাকায় নদী সচল থাকলেও নবগঙ্গার কুন্দশী এলাকা থেকে মহাজন এলাকা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটারের অবস্থা এতটাই সঙ্কীণ যে, অনেক এলাকায় নবগঙ্গা শুকিয়ে পায়ে চলা সরু পথে পরিণত হয়ে পড়েছে। বর্ষায় নদীতে চলাচলের উপযোগী থাকলেও অন্য সময় একবারেই বন্ধ হয়ে যায় এ সব এলাকা।
নবগঙ্গা নদীর লোহাগড়া বাজারের সেতুর পাশে চর বানিয়ে সরকারীভাবে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সেখানে তৈরী করা হয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান, লোহাগড়া পৌরভবন নির্মানের জন্য বালি ভরাট করে জমি তৈরীর উদ্যোগ নেয়া হয়। লোহাগড়া বাজারের দুই পাড়ে টোং ঘর তুলে নদী দখল করে ব্যবসা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এছাড়া নদীর জায়গায় ঘর তুলে বসবাসও করছেন কেউ কেউ। নদীর বিভিন্ন এলাকায় মরে যাওয়া অংশে সরকারি ভাবে গড়ে উঠেছে আশ্রয়ন প্রকল্প। নদীর জায়গায় এই আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ে উঠার ব্যপারে স্থানীয়ভাবে বাধা দিলেও সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ক্ষমতার কাছে হার মেনেছে নবগঙ্গা পাড়ের মানুেষরা। নদীর জায়গার আরো কয়েকটি স্থানে শ্রেনী পরিবর্তন করে তৈরী হয়েছে আশ্রয়ন প্রকল্পের বাড়ি আর গুচ্ছগ্রাম। এভাবে নবগঙ্গা নদী বাঁচাতে স্থানীয়ভাবে চেষ্টা চালালেও নদীপাড়ের ভূমিখেকোদের দখলে দিন দিন অস্থিত্ব হারাতে বসেছে এক সময়ের খরস্রোতা নবগঙ্গা।
নদী শাসন করে অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়িসহ কাঁচা-পাকা বিভিন্ন স্থাপনা। নদীর মাঝখান পর্যন্ত বাঁধ দিয়ে নদী থেকে মাটি কেটে ভরাট করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। প্রভাবশালীরা ঘের বানিয়ে করছেন মাছ চাষ। এ অবস্থায় লোহাগড়া উপজেলা সদরের লক্ষীপাশা থেকে দক্ষিণে মহাজন বাজার পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার নদীটি সরু খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও পানি ছাড়া আছে শুধু কাদামাটি।
শীত মৌসূম শুরুর সাথে সাথে নবগঙ্গা নদীর নাব্যতা অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে লোহাগড়া-নড়াইল ভায়া খুলনা রুটে নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ফলে নৌ পথে পণ্য পরিবহণে চরম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ব্যবসা বাণিজ্যে নেমেছে ধস। এক কথায়, দখল আর দূষণে এককালের খরস্রোতা নবগঙ্গা নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়ে মৃতপ্রায় নদীর তালিকায় স্থান পেয়েছে।
এলাকাবাসীর দাবি নবগঙ্গা নদীকে দখল এবং দুষণ মুক্ত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা মনে করেন সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা থকলেই নবগঙ্গা ফিরে পেতে পারে নাব্যতা।