Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি মেলেনি ঝালকাঠির কমলা বেগম’র মুক্তিবার্তাঝালকাঠি

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি মেলেনি ঝালকাঠির কমলা বেগম’র

ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের বীরাঙ্গনা কমলা বেগম এখন পাগল প্রায়। ১৯৭১ সালে পাকসেনাদের হাতে পৈশাচিক নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে কাটছে তার জীবন। পাক বাহিনীর ঔরশে জন্ম নেয়া ছেলেটি হারিয়ে তার মানসিক যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তার বীরাঙ্গনার খেতাব না জোটায় জীবন চলছে রিকশা চালক ছেলের আয়ে আর অন্যের কাছে চেয়ে চিন্তে। তার আশা মৃত্যুর আগে একমাত্র ছেলের একটু মাথা গোঁজার ঠাই দেখে যেতে চান। কমলার ছেলে রিকশা চালক জামাল মাকে নিয়ে শ্বশুরের দয়ায় একটু ছাপড়া ঘরে কোন মতে দিন কাটাচ্ছে। পাক সেনা ও রাজাকারদের বর্বর নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন তিনি। ঝালকাঠির শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামে এক নিভৃত পল্লতে থাকেন মানসিক ভারসাম্যহীন বীরাঙ্গনা কমলা বেগম। ঝালকাঠি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দুরে শেখেরহাট ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের মরহুম জেন্নাত আলীর ৩য় কন্যা সুন্দরী কমলা বেগম। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার ১৪ বছর। 

এলাকাবাসি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের খায়েরহাট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেন। ক্যাম্প স্থাপনের ৪/৫ দিন পর এলাকার শামসু মিয়া ও মুনসুর আলী রাজাকার পাকসেনাদের নিয়ে মির্জাপুর গ্রামে কমলা বেগমের বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে রাজাকারদের পাহারা রেখে দলবদ্ধভাবে পাকসেনারা কমলা বেগমের উপরে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। সেই থেকে রাজাকারদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হন কমলা বেগম। এক মাস পর সুযোগ পেয়ে কমলার আত্মীয়স্বজন কমলাকে সরিয়ে ফেলে। কমলাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পাকসেনা ও তার দোষরা। এলাকার বাড়ী ঘর লুটপাট অগ্নিসংযোগ দেয়ার উদ্যোগ নিলে গ্রামের পাক সেনা বাহিনীতে কর্মরত শেখেরহাটের জনৈক মেজরের পিতা পাকসেনাদের বুজিয়ে অগ্নি সংযোগ থেকে বাড়িগুলো রক্ষা করেন। স্বাধীনতার পরে কমলা বেগম গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে। সে জন্ম দেয় এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হয় কামাল। আত্মীয় স্বজন খুব গোপনীয়ভাবে কমলার জন্ম দেয়া সন্তানকে লালন-পালন করে ২ বছর পর পুত্র সন্তান কামালকে একটি এতিম খানায় হস্তান্তর করে। কামাল বড় হলে সে জানে তার মা নেই। ১৮ বছর বয়সে কামাল জন্ডিস রোগে অক্রান্ত হয়ে মারা যায়। 

এদিকে তার ভাইয়েরা কমলাকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার জৌসার গ্রামের হাসেম আলীর সঙ্গে বিয়ে দেন। সে ঘরে কমলার একপুত্র ও এক কন্যা সন্তান জন্ম দেয়। স্বামী হাসেম আলী এক সময় জানতে পারে কমলার অতীতের ইতিহাস। সন্তান জন্ম দেয়ার পরই হাসেম আলী স্ত্রী কমলা বেগম ও সন্তানদের রেখে নিরুদ্দেশ হন। সেই থেকে কমলা বেগম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে স্বামীর সন্ধানে বের হন। তার পুত্র রিকশা চালক জামাল তার মাকে শ্বশুরের দেয়া একখন্ড জমিতে ঘর তৈরি করে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামে থাকে। 

সম্প্রতি কমলা বেগমের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, কীর্তিপাশা বাজারেই সব সময় ভবঘুরের মতো হাটা চলা করেন। মানুষ সব সময় ভালোবেসে খাবার দেয়। আবার ছেলে জামাল খুঁজে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়। ছেলে সংসারেই তার জীবন চলছে। 

এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার দুলাল সাহা বলেন, ঝালকাঠির মুক্তিযুদ্ধের সে সময়কার মানুষজন ও মুক্তিযোদ্ধারা সকলেই জানে বীরাঙ্গনা কমলা বেগমের ইতিহাস। দেশের জন্য তার আত্মত্যাগ অম্লান হয়ে থাকবে। তাকে বীরঙ্গনা নারী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। 

ছেলে জামাল মিয়া বলেন, আমি আমার মায়ের জন্য গর্ববোধ করি। তার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডে একাধিক আবেদন করেছি। কিন্তু কোন ফল হয়নি। আমি আমার মায়ের দেশের জন্য এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি চাই। 

বীরাঙ্গনা কমলা বেগম জানায়, স্বামী চইলা গেছে। আমাকে মিলিটারিরা নষ্ট করছে শেখেরহাট ক্যাম্পে। সেখানে হাত ধইরা লইয়া গেছে রাজাকার শামছু ও মুনসুর । এ কারনে আমার স্বামী ফালাইয়া চইলা গেছে । আমার ১৮ বছরের ছেলেও মইরা গেছে। সরকার আমাকে স্বীকৃতি দিলোনা। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আতাহার মিয়া বলেন, আমরা শুনেছি সে একজন ত্যাগী মানুষ। তার এই স্বীকৃতি আগে পাওয়া উচিত ছিল। তার অতীত ইতিহাস সত্যিই বেদনাদায়ক। আমরা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত তার স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করবো।