রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার : ড. মুহাম্মদ মেহেদী মাসুদ মতামত / 
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করেও নেই কোন মানবাধিকার । মানুষের সব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও, আবদ্ধ হয়ে আছে যেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে। আবেগ, অনুভূতি, সুখ, দুঃখ সবই আছে মানুষের মতো। তাদের বুকফাটা আহাজারিতে যেন আকাশ, বাতাস, ভারী হয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বমানবতা যেন কিছুই শুনতে পায়না, তাদের নেই কোনো মাথা ব্যথা, তারা যেন মুখ চেপে মুচকি হাসছে, আর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ক্ষত বিক্ষত দেহের উপর নৃত্য করছে। যাদের উপরে আবহমান কাল ধরে চলে আসছে অত্যাচারের স্টিম রোলার, তাদের আবার কিসের অধিকার? যাদের বেঁচে থাকারই নেই কোনো অধিকার, তাদের আবার মানবাধিকার!
আজকে যাদের মানবতা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে , তাদের মানবতা আজ আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে, শকুনে আর হিংস্র জানোয়াররা ছিন্ন ভিন্ন করে খাচ্ছে। যাদের মানবতা আজ নাফ নদীতে সলিল সমাধি, তাদের মানবতা আজ অসহায়, নারী, পুরুষ আর শিশুদের ক্ষতবিক্ষত, বুলেট বিদ্ধ , ধর্ষিত দেহ। হাজার বছরের সমৃদ্ধও ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আজ তারা উদ্বাস্তু। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার। চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অত্যাচারের খড়গ। কেড়ে নেয়া হয়েছে হাজারও নিরীহ মানুষের প্রাণ, আর মা বোনের সম্ভ্রম। অতীতের সমস্ত নিষ্ঠুরতার ইতিহাস ভেঙ্গে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা । এমন বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা কখনো ও দেখেনি বিশ্ব মানবতা । হার মানিয়েছে মুসলমানদের চির শত্রু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ।
আশায় বুক বেঁধেছিল রোহিঙ্গা মুসলিমরা মায়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার তাদের দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি এনে দিবেন শান্তির মহান বার্তা । কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন এই রক্ত চোষা নরপিচাশ বুজিয়ে দিলেন তার নীরবতার সংজ্ঞায়। তিনিই হলেন সকল হত্যাযজ্ঞের মূল নায়িকা। ইতিহাস ওনাকে অশান্তি বেগম আর মিথ্যা বাদী হিসাবেই চিনবে।
কিছু শিক্ষাবিদরা ‘রোহিঙ্গা সঙ্কটকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় চিহ্নিত করেছেন যেমন: ‘প্রথমত, এটি চীনের বিরুদ্ধে একটি খেলা, যেহেতু চীন আরাকানা রাজ্যে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, দ্বিতীয়ত, এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মুসলমান চরমপন্থাকে উসকে দেবার একটা পায়তারা করছে। তৃতীয়ত, এটি আসিয়ানের (মিয়ানমার ও মুসলিম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে) বিরোধ বাধানোর এক গভীর ষড়যন্ত্র।’
কিন্তু এটা আয়নার মতো স্বচ্ছ যে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মুছে ফেলার এক গভীর ষড়যন্ত্র। এটা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে, রোহিঙ্গা মুসলিদের উপর অত্মাচারের খড়গ নেমে আসার আগেই মিয়ানমার সরকার সব বৌদ্ধ গ্রামবাসীকে রাখাইন রাজ্য থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। এটাই প্রমাণ করে যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামে সারা মিয়ানমারকে ‘মুসলিম ফ্রি জোন’ তৈরির জন্য মিয়ানমার সরকারের সাজানো গুছানো একটি এজেন্ডার বাস্তবায়ন আর পাশবর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নকে ব্যাহত করাই তাদের লক্ষ্য ।
তথাকথিত ‘মানবাধিকার সংগঠন গুলি’ আজ দাবা আর লুডু খেলায় মত্ত, কুলুপ এঁটেছেন যেন তাদের মুখে। বিশ্ব নেতারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। আগ্রহী নন তারা এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে। কেন এই নীরবতা? কারণটা খুবই সহজ, এটা তাদের কমন এজেন্ডা শুধু রোহিঙ্গা মুসলমানদেরই নয় বরং সকল মুসলমানদেরকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ মাত্র।
আজকে ৫৭ টি মুসলিম দেশের ১.৭ বিলিয়ন মুসলমান থাকা সত্বেও, তাদেরকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায় তারা ! কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয়, ওয়েস্টার্নদের পা-চাটা মুসলিম লিডারদের ঘুম আজও ভাঙেনি! তারা এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন, কখন তাদের এ ঘুম ভাঙবে? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, এবং মালয়েশিয়ার মত সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছেন না কেন? কখন তারা অমানুষের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে? মুসলমানদের আর বসে থাকার সময় নাই । এক্ষুনি উপযুক্ত সময় রুখে দাঁড়াবার আর গর্জে উঠার। মুসলমানদের সকল হীনমন্যতা আর পরশ্রীকাতরতার গ্যাঁড়াকল থেকে বেরিয়ে এসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে ।
বুঝতে হবে এটা বাংলাদেশের কোনো একক সমস্যা নয় এটা বৈশ্বিক সমস্যা। অবশ্যই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এটি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে অজানা নয় যে বিশ্বের দরিদ্রতম, ক্ষুদ্রতম এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ তার নিজের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দেবার জন্য ক্রমাগত সংগ্রাম করছে। সেখানে ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেয়াটা কত যে কষ্ট সাধ্য, তা সহজেই অনুমেয়! তারপরেও মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য নৈতিক, আর্থিক ও মৌলিক সেবা প্রদান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি এবং আরো যারা ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলি বিভিন্ন উপায়ে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
লেখক : ড. মুহাম্মদ মেহেদী মাসুদ
সহকারী অধ্যাপক
ইউনিভার্সিটি অফ মালায়া, মালয়েশিয়া