Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

ভর্তিযুদ্ধে ভোগান্তি এবার আরও বাড়বে! শিক্ষা

ভর্তিযুদ্ধে ভোগান্তি এবার আরও বাড়বে!

উ”চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি যুদ্ধে এবার আরও ভোগান্তি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছরের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৮১ ভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছে। এছাড়া ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৮৩ ভাগ এবং ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৮১ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। এসব শিক্ষার্থী ১২০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর ৪৮ পায়নি। এ পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উ”চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে। শহরের শিক্ষার্থীরা টাকা খরচ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটছে উ”চ মাধ্যমিকে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, উ”চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্য থাকে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মাধ্যমে বাদ দেয়া, নেয়া নয়। এটা করতে গিয়ে তারা নানা কৌশল অবলম্বন করে। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে থাকে। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে মফস্বলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে গৎবাঁধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি এ ধরনের পদ্ধতি পছন্দ করি না। এখন কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় পড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা লিখতে পারে কিনা, সেই পরীক্ষা নিতে হবে। তাদের ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে জানতে রচনা লেখার ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় শর্তারোপের বিষয়ে তিনি বলেন, বিভাগগুলো কেমন শিক্ষার্থী নেবে সেই স্বাধীনতা তাদের থাকা উচিত। তবে এ সুযোগের কারণে যেন আসন ফাঁকা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এইচএসসির ফল প্রকাশ হলেই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন শুরু করে। ভোগান্তির শুরু এখান থেকেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে আবেদন করতে হয়। সীমিত আসন থাকায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আবার একাধিক ইউনিটে আবেদন করতে বাধ্য হয়। আর্থিক চাপের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হয় এ ভর্তিযুদ্ধে নেমে। আবেদন প্রক্রিয়া অনলাইনে হলেও প্রবেশপত্র পেতে লেগে যায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘসময়। প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়, পরে যাচাই-বাছাইয়ের সময় দেয়া হয় এবং প্রবেশপত্র সংগ্রহের সময় বেঁধে দেয়া হয়। ফলে আলাদা সময় নিয়ে শিক্ষার্থীদের আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হয়। হাতে সময় কম থাকায় শিক্ষার্থীরা এইচএসসির ফল প্রকাশের আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য পড়াশোনা শুরু করে।
এইচএসসির সিলেবাসের বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন প্রণয়ন তাদের ভোগান্তির অন্যতম কারণ। দেশের প্রধান ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে এমন কিছু বিষয় আনা হয়, যার সঙ্গে এইচএসসির সিলেবাসের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ জ্ঞান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়নে শিক্ষার্থীদের ওইসব বিষয়ে আলাদাভাবে প্র¯‘তি নিতে হয়।
এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যও গণিতবিষয়ক প্রশ্ন থাকে। যেহেতু উ”চ মাধ্যমিকে মানবিক শিক্ষার্থীরা গণিত পড়ে না, তাই বেশিরভাগই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কোচিং সাম্রাজ্য। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কোচিং সেন্টারগুলো নানাভাবে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে ভর্তিতে উৎসাহিত করে।
সেখানে প্রতিটি বিষয়ের জন্য সংক্ষিপ্ত প্র¯‘তির উপায় শেখানো হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারমুখী হতে বাধ্য হয়। সে কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের উদ্যোগ নিলেও শিক্ষার্থীরা কোচিং বিমুখ হচ্ছে না। তারা বরং একাদশ শ্রেণী থেকেই কোচিং সেন্টারের পথে হাঁটা শুরু করেছে। একদিকে ভর্তি আবেদনের খরচ, অন্যদিকে কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য অতিরিক্ত অর্থ জোগাতে হিমশিম খায় অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা।
ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও তৈরি হয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির জন্য পৃথক তারিখ নির্ধারণ করে। এর ফলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। ছাত্ররা অভিভাবক ছাড়া পরীক্ষা দিতে গেলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে ছাত্রীরা তা পারে না। ফলে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যেতে হয়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, উ”চ মাধ্যমিকে ভর্তির মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করা গেলে হয়রানি কমে আসবে।
নানা সমস্যার মধ্যে যে ভর্তিযুদ্ধে শিক্ষার্থীরা অবতীর্ণ হন, তাতেও থাকে নানা বৈষম্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ঘ ইউনিটে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০টির মতো আসন থাকে। যেখানে বিজ্ঞান বিভাগ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য আসন থাকে প্রায় দুই হাজার। একই প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়া সত্তে¡ও এ রকম আসন বণ্টনকে বৈষম্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও অনেকটা একই রকম।
এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী একই ইউনিটে বিভিন্ন শিফটে পরীক্ষা হয়। প্রতিটি শিফটের জন্য আলাদা প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। কোনো শিফটে প্রশ্ন সহজ হয়, কোনোটায় কঠিন। ফলে যে শিফটে প্রশ্ন সহজ হয়, সেই শিফট থেকে বেশি সংখ্যায় চান্স পাওয়ার নজির রয়েছে। এছাড়া প্রশ্নে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত বিষয় থাকায় বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেই এ ধরনের নানা অসঙ্গতি রয়েছে।
এ বছর শিক্ষার্থীরা অতীতের তুলনায় বেশি হয়রানির শিকার হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আগে এইচএসসির ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য শিক্ষার্থীরা ৫-৬ মাস সময় পেলেও এবার তা কমে গেছে। এবার ফল প্রকাশের দুই মাসের মাথায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে কম সময়ে ভর্তি পরীক্ষার প্র¯‘তি নিয়ে বিপাকে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। কম সময়ের প্র¯‘তিতে এইচএসসি সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন হলে তার উত্তর দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন পদ্ধতি ও পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে, নতুবা পরীক্ষা গ্রহণের সময় বাড়াতে হবে।
ভর্তি প্রক্রিয়ার জটিলতা ও ত্রুটির কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। আর্থিক সমস্যা, এইচএসসিতে উপযুক্ত পরিচর্যা ও দিকনির্দেশনার অভাবে এ বছর উ”চশিক্ষায় ভর্তিতে গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়তে পারে। আর্থিক দৈন্যের কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অনেকেই কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারে না।
এছাড়া গ্রাম থেকে এসে শহরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও বেশ সময় লেগে যায়। ফল প্রকাশের কম সময়ের ব্যবধানে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এসব শিক্ষার্থী নানাভাবে শহরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।