Opu Hasnat

আজ ২৯ মার্চ শুক্রবার ২০২৪,

কুন্তল-কবরীও অভিনয় করলো ইসরাফিল শাহিনের নির্দেশনায়! বিনোদন

কুন্তল-কবরীও অভিনয় করলো ইসরাফিল শাহিনের নির্দেশনায়!

শেখ জাহিদ আজিম : আলাপের বিষয় নাটক ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’। গদ্য-পদ্য-বাদ্য-নৃত্য-সুর-সংলাপ সব মিলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এই নাট্যশিল্প বিলাপ। মূল নাটক ‘ফ্রেইড্রা’ জ্যঁ রাসিনের একটি ধ্রুপদী নাটক। যা নব সৃজনে ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’ নামে ১৮ মে মঞ্চে সমাপনী পরিবেশনা করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের নাট্য জ্ঞানে স্নাত সপ্ত তরুণ নাট্যকর্মী। প্রযোজনাটির প্রধান বিশেষত্ব পশ্চিমা দ্বন্দ্ব ভিত্তিক আঙ্গিক ও রীতির সাথে উপমহাদেশীয় রস ভিত্তিক আঙ্গিক ও রীতির সংশ্লেষণ ঘটিয়ে নব চেহারায় দর্শক-মুকুর সম্মুখে উপস্থাপন।  যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কেবল পাঠদান নয় তার প্রমাণ এই নাট্য প্রযোজনা। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সংগ্রহ করবে, চর্চা করবে, নতুন জ্ঞান সৃজন করবে এবং তা বিতরণ করবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। এই নাটকে আমরা তার চিহ্ন পাই বৈকি। কেননা পশ্চিমা ও দক্ষিণ এশিয়ান নাট্য ভাষা ধার করে নতুন নাট্য ভাষার সৃজন, তারই জানান দেয়। এবং নাটকটি নিশ্চিতভাবে একটি নিরিক্ষাধর্মী, প্রাজ্ঞ নির্দেশক অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীনের জবানে, “আমরা এই প্রযোজনার মর্মস্থলে বা পরতে পরতে অভিনয়, দৃশ্যগত উপাদান যেমন মঞ্চ, আলো, পোশাক, রূপসজ্জা, দেহবিন্যাস এমনকি বিষয়বস্তু বা পান্ডুলিপিগত দিক থেকেও সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে পুনঃসৃজনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি”। নাটকটিতে পান্ডুলিপিগত জায়গা থেকে যে পরিবর্তন তা মূলত গীত ও গায়েন কথন সংযোজন। নাটকের মূল গল্পের কোন হেরফের করা হয় নি। এতে গীত ও বর্ণনায় লোকনাট্য আঙ্গিকের স্বাদ পাওয়া যায়। তবে আলোর ক্ষেত্রে এ দেশীয় আলোর সারল্যতা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যা নাটকের উপস্থাপনায় আড়াআড়ি পথের দিশা দিয়েছে। কিন্তু সাদা আলোতে উপস্থাপন করলে কুশীলবগণ যেমন বহুগুন বেশী চ্যালেঞ্জ নিতে পারতো তেমনি দর্শক নাটকের সাথে আরো বেশী ফানা হতে পারতো। তবে নাটকে ব্যবহৃত আলো আঁধারী আলোর পরিকল্পনা ও প্রক্ষেপণের যথার্থতায় দর্শক নাটকে অনেক বেশী মহাবিষ্ট ছিল। যার কৃতিত্বের দাবিদার আলোক পরিকল্পক আশিক রহমান লিয়ন। যদিও নাটকটি ধ্রুপদী ধারার কিন্তু এর মধ্যে লোকনাট্যের যে লৌকিকতা ও পুরাণ থাকে তেমনি এ নাটকেও বিদ্যমান। ময়মনসিংহ গীতিকার অন্তর্ভুক্ত ‘কমলা রাণীর সাগর দিঘী’-তে যেমন পাতাল পুরীতে দেবতা থাকে, ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যে যেমন পাতাল পুরী থেকে মনসা দেবী উঠে আসে। তেমনি এ নাটকে সমুদ্র দেবতা নেপচুন আছে। যে গুলো লৌকিক বা ধর্মীয় পুরাণ। পুরাণ বলতেই পুরাতন। নাটকে সকল পুরাতনকে সরিয়ে যদি উত্তম নতুনকে বসানো যায় তবে পুরাতন পুরাণ কিংবা দেবতাদের কেন নয়? এ সময়ে এসে এমন দাবি নির্দেশক অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীন কিংবা ড্রামাতুর্গ শাহমান মৈশানের নিকট রাখা যেতেই পারে। যেখানে কোন কোন দেবতা আবার সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই সরিয়ে দিতে চায়! তাই নতুন সৃজন প্রক্রিয়ায় অভিনয়, সংলাপ, মঞ্চ, আলোর পাশাপাশি নতুন কোন মানবিক দেবতার অবতারণা করা যেতেই পারতো। কেননা তর্কে মিলায় বস্তু, তাই বিশ্বাসে আঘাত করতেই হবে। নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় নিয়ে সমালোচনা করার মত সাহস কোন দর্শক বোধ হয় নাটকটি দেখার পর করবে না। কারণ নাটকটিতে কুশীলবরা এতটাই সফল যে তাদের প্রতি উপাঙ্গগুলোও যথার্থ ক্রিয়াশীল ছিল। যেখানে কুশীলবের কুন্তল-কবরী, ভ্রু-পাপড়িও অভিনয়ে জীবন্ত ছিল। যার শতভাগ প্রশংসার দাবি রাখে নাটকটির প্রাজ্ঞ নির্দেশক। নাটকটি দেখে একজন সাধারণ দর্শকের অভিব্যক্তি ছিল এ রকম, “ নাট্যকলার পোলাপান অভিনয়ে তো ফাটাইয়া দিছে”। এই অভিব্যক্তির পেছনের রহস্য হয়তো নির্দেশকের লোকনাট্যিক অভিনয় রীতির সাথে সাত্ত্বিক ও গ্রোটস্কিয়ান অভিনয় দর্শন সংশ্লেষণ, যা সচেতন দর্শক মাত্রেই উপলব্ধি করতে পারবে। আর নির্দেশক যে পাত্র-পটে এই অভিনয়ের ছবি এঁকেছেন তাঁরা হলেন, ইলিয়াস বাসেত, আফরিন তোড়া, ইসতিয়াক খান পাঠান, ধীমান চন্দ্র বর্মণ, রাণা নাসির, সাওগাতুল ইসলাম হিমেল ও সাফোয়ান মাহমুদ। যাদের প্রত্যেকেই সাধুবাদ পায়ই পায়। নাটকের বিশেষ একটি আকর্ষণীয় দৃশ্য ছিল এরিসিয়া চরিত্রে রানা নাসিরের লোকনাট্য রীতির ছুকরির ভূমিকায় অংশগ্রহণ করা। যা ইউরিয়ান নাটকে সফল ও নতুন প্রয়োগ। নাটকটিতে পোশাক পরিকল্পনায়ও ওয়াহিদা মল্লিক নতুনত্ব ও চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন। যাতে আহার্য অভিনয়ের হিল্লায় অভিনেতাদের অভিনয়ের সরাবান তহুরা পানে সহযোগিতা করেছে। যেহেতু প্রাজ্ঞ নির্দেশকের দিক নির্দেশনা, যেহেতু সুপ্রশিক্ষিত কুশীলবদের প্রযোজনা, যেহেতু যথার্থ আলোক পরিকল্পনা, যেহেতু সঠিক পোষাক ব্যঞ্জনা, সেহেতু নাটক দেখে দর্শকের এতো উন্মাদনা। তাই প্রার্থনা, হোক আরো এমন প্রযোজনা, হোক সৃজনে এমন আরো নাট্য উন্মাদনা।