Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ সারাবাংলাচট্টগ্রামখাগড়াছড়ি

আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ

বর্তমান প্রেক্ষিত ও করণীয়” শীর্ষক জাতীয় সেমিনার বুধবার  সকাল ১০টায় আজিমুর রহমান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর সহযোগিতায় এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফজলে হোসেন বাদশা, এমপি ও সভাপতি, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস। সম্মানিত অতিথিবৃন্দ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. জ্ঞানেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, অতিরিক্ত সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডা. শামীম ইমাম, পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
সম্মানিত আলোচকবৃন্দ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. নারায়ণ চন্দ্র পাল, চেয়ারম্যন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড; প্রিয়জ্যোতি খীসা, যুগ্ম সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়; অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার, ভাষাতত্ত¡ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; তপন কুমার দাশ, উপ-পরিচালক, গণ স্বাক্ষরতা অভিযান; ওয়াসিউর রহমান তন্ময়, প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক  মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা ।
ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা আন্দোলনের সাথে আমি প্রায় ২৪ বছর ধরে জড়িয়ে আছি। বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ যে প্রকৃত সমাজ সেটা নিয়ে এখনো কিছু মানুষ খুব মেনে নিতে পারেনা। সাঁওতালদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে ভেবে মনটা খুব খারাপ লাগে। মাতৃভাষায় শিক্ষা আদিবাসী ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করে। আমরা আদিবাসীদের ভাষাকে গলা টিপে ধরার যে চেষ্টা করছি তাতে করে পািকস্তানি ধ্যান ধারনার মিল পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি আমরা পাকিস্তানি হয়ে যাচ্ছি। রোমান এবং বাংলা বর্ণমালা’কে পাশাপাশি রেখে সাঁওতালদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে, কেননা সাঁওতালদের বাদ দিয়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম খুব বেশী প্রশংসার দাবি রাখবে না।
ড. জ্ঞানেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, মালদ্বীপের শিশুরা তাদের মাতৃভাষা জানতো না। বর্তমানে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজস্ব ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সকলের নিজের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের অধিকার রয়েছে। আজকে চাকমা’রা সবচেয়ে উন্নত এবং শিক্ষিত। কিন্তু নিজেরাই তাদের মাতৃভাষায় পড়তে লিখতে জানেনা। তাহলে এই উদ্যোগ কতদূর এগুবে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। ‘এমএলই ফোরাম’ এর সদস্যরা সরকারকে যদি আরেকটু চাপে রাখেন তাহলে আমাদের কাজ দ্রæত হবে। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পরবর্তী ক্লাসের জন্য পুস্তক রচনার কাজ শুরু করা ইত্যাদি বিষয় এখন থেকেই শুরু করতে হবে। সরকারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান নিজেরা নিজেরা কাজ করে, কিন্তু অর্থ বরাদ্দ শেষ হলে তারা সরকারকে সেটা নিতে বলে। কিন্তু এটা এভাবে সম্ভব হয়না। সরকারকে জানিয়ে করলে সরকার সেটি বিবেচনায় রাখে।
অধ্যাপক ড. নারায়ন চন্দ্র পাল বলেন, এমএলই এবং এনসিটিবি যৌথভাবে কাজ করছে এবং সেটি প্রায় শেষ।  ২০১৬ সালে আমরা অবশ্যই আদিবাসী শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারবো। কিন্তু প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় শেষ করার পরে শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। সেটির পুস্তক রচনা করার ব্যাপারটিও এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ডা. শামীম ইমাম বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারটি একটি আন্দোলন। আমরা এর একটি পর্যায়ে আছি, আমাদের সামনে আরো পথ বাকি আছে। সরকারী কিছু সীমাবদ্ধতা আছে তবে এর পাশাপাশি কিছু শর্তও অনেক সময় শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা হয়। আমরা ২০১২ সাল থেকে কাঠামোবদ্ধ কার্যক্রম শুরু করেছি। মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুধু সেমিনার, ওয়ার্কশপ নয়। সহযোগী সংস্থাগুলো পাশে আছে। প্রাথমিক স্তরের বই বিনামূল্যে বিতরণের একটি উৎসব হয়ে থাকে। এরপর দেখা যায় শিক্ষার্থীরা বাজার থেকে একটি গাইড বই কিনে আনতে বাধ্য হয়।
অধ্যাপক ড.সৌরভ সিকদার বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর মধ্য দিয়ে যে আমাদের গন্তব্য তৈরী হয়েছিল সেদিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। প্রাক-প্রাথমিক এর জন্য বই তৈরির কাজও প্রায় শেষ। কোন ভাষায় কত জন শিক্ষক প্রয়োজন সে জন্য শিক্ষদের চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে সমস্যা হতে পারে। তবে সেটি শুরু করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ হয়নি। কোন কোন বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় মিক্ষা কার্যক্রম হবে সেটিও নির্ধারিত হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে সাঁওতালি ভাষা যেন বাদ না যায় তার জন্য এখন থেকে কাজ করতে হবে। একইসাথে দুই বর্ণমালায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করাটা বিজ্ঞান ভিত্তিক হবেনা।
তপন কুমার দাশ বলেন, আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা চালুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে উচ্চ পর্যায়ের বেশ কিছু নীতিনির্ধারকরা এখনো মনে করে এটির প্রয়োজন নেই। প্রি-প্রাইমারী চালু করতে এখনো যে অবস্থা তাতে প্রথম, দি¦তীয়, তৃতীয় পর্যায়ের স্কুল শুরু করতে হলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। পিডিপি-৩ এসব ক্ষেত্রে কোন কাজ করতে না পারায় সে টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারকে সাহায্য করবে। এবং মন্ত্রণালয়ের যে কমিটি সেটিকে গতিশীল করা প্রয়োজন।
প্রিয়জ্যোতি খীসা বলেন, সরকার খুবই আন্তরিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে।
ওয়াসিউর রহমান তন্ময় বলেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তায় তিন পার্বত্য জেলায় ৩৩৭টি বিদ্যালয়ে প্রায় ২৪ হাজার ৪২৬ জন ছেলেমেয়ের শিক্ষা চলছে। এর মধ্যে ৬৬টি স্কুলে ৫,৫৯৫ শিক্ষার্থীর মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। মাতৃভাষা শিক্ষা নাকি মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়ে এখনো আমাদের দ্ব›দ্ব আছে। আয়বর্ধনমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলে পরবর্তীতে তারা নিজেরোই এনজিওদের অর্থায়নে পরিচালিত স্কুলগুলো পরবর্তীতে চালাতে পারবে। কারণ এনজিওরা নিশ্চয় সারাজীবন অর্থায়ন করবেনা।
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাসদের রাজেকুজ্জামান রতন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মঙ্গল কুমার চাকমা, হ্যাপি দেওয়ান (সেভ দ্যা চিলড্রেন), নিখিল চাকমা (মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন)। মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন ১১টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষার মাতৃভাষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ মথুরা ত্রিপুরার তথ্য মতে এখনো ৫টি ভাষার শিক্ষাও শুরু হয়নি।
সভাপতির বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, গত ৪/৫ বছর হয়ে গেল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেভাবে কোন কার্যকর পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করতে পারেনি। আদিবাসীদের অনেকেরই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। এখানে বিভিন্ন বর্ণমালাকে ব্যবহার করেই আদিবাসীরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা চর্চার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিবে।
মূল প্রবন্ধে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, তিন পার্বত্য জেলা, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল, বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, বগুড়া, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, গাজীপুর, রাজবাড়ি, কুমিল্লা, চাঁদপুর ইত্যাদি অঞ্চলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ আদিবাসী জাতিসমূহের বসবাস এবং তাদের প্রত্যেকের আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তাঁদের সাক্ষরতার হার সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে সাম্প্রতিক জনগণনা জরিপ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাক্ষরতার হার  ৪৩.৯ শতাংশ, যা জাতীয় হার হতে ৭.৯  শতাংশ কম এবং চট্টগ্রাম বিভাগে হার থেকে ৮.৮ শতাংশ কম (জাতীয় হার ৫১.৮% এবং চট্টগ্রাম বিভাগের হার ৫২.৭%)।
আমাদের মহান সংবিধানে ‘শিক্ষা’-কে নাগরিকদের জীবন ধারনের মৌলিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৫) এবং ‘শিক্ষা’-কে সার্বজনীন এবং নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে [অনুচ্ছেদ ১৭(ক)]। এছাড়াও ‘সমাজের প্রয়োজনের সংগে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ’-এর কথাও মহান সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে [অনুচ্ছেদ ১৭(খ)]। আমাদের সংবিধান ‘ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারনে .. .. কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিকের কোন রকম অসমতা, বাধ্যবাধকতা বা শর্তের অধীন করা যাবে না বলে বিধিনিষেধ নির্ধারণ করে দিয়েছে [অনুচ্ছেদ ২৮(৩)] ।
সরকারী বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশলপত্রে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে আদিবাসী শিশুদের স্ব স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে গুণগত মৌলিক শিক্ষার অধিকার অর্জনের নানা অভিপ্রায় আমরা দেখতে পাই। ১৯৯৭ সনে সম্পাদিত পাবর্ত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ১৯৯৭-এ ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা’ [ধারা ৩৩(খ)(২)] দানের কথা বলা হয়েছে। ১৯৯৮ সনে গৃহীত রাঙ্গামাটি ঘোষনাপত্রেও মাতৃভাষার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের বিষয় উল্লেখ রয়েছে (রাঙ্গামাটি ঘোষনাপত্র, ১৯৯৮; শিক্ষা: ৫৩)। দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রে (২০০৫) আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ সম্বলিত পাঠ্যসূচী প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে (চজঝচ ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৫২-৫৩) । দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’র অধীনে ‘ট্রাইবেল শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার পরিস্থিতি বিশ্লেষন, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা’ নামে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ কর্ম পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের মধ্যে শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের ক্রম-বৃদ্ধি, শিক্ষার মানের উন্নয়ন এবং তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তরনের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষার ব্যবহারের গুরুত্বকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। পার্বত্য জনগোষ্ঠির শিশুরা যাতে নিশ্চিতভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে তার জন্য এটিই প্রথম সরকারী পরিকল্পনা, যেখানে- স্থানীয় ও আদিবাসী ভাষা জানা আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগকৃত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দান, প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, পাঠ্যসূচীতে আদিবাসী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সংযুক্ত করা, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা এবং নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা, স্কুল ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা, স্কুলের পাঠক্রম তত্ত¡াবধান ও পর্যবেক্ষণ করা ও স্থানীয় পরিস্থিতির সংগে মানানসই স্কুল পঞ্জিকা প্রচলন । ২০১১ সালে গৃহিত এই কর্মসূচির  তৃতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনায়ও ‘জেন্ডার এন্ড ইনক্লুসিভ এডুকেশন একশন প্লান’ নামে প্রণীত বিশেষ পরিকল্পনায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুনির্দ্দিষ্ট কিছু কর্মসূচী বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতি হিসেবে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্রজাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা(য়) শিখতে পারে সেজন্যে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করা, আদিবাসী এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা, প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল জাতিসত্তার জন্যে স্ব স্ব মাতৃভাষা(য়) শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা, যেসব এলাকায় হালকা জনবসতি রয়েছে প্রয়োজন হলে সেসব এলাকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা এবং এলাকার জীবন-জীবিকা ও মৌসুম অনুসারে স্কুলপঞ্জিকা নির্ধারণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম কৌশল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে, যার আওতায় বিদ্যমান কর্মসূচীগুলোকে পর্যালোচনা ও পূনর্বিন্যস্ত  করে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, উপজাতী, নারী ও শিশুদের মত স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীসমূহ যাতে সুবিধা বন্টনকালে অগ্রাধিকার পায় তার জন্য ‘সামাজিক নিরাপত্তাজাল কর্মসূচী’ গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবি’র উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে মূলত মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এরপর থেকে এমএলই হিসেবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উল্লেখ করবো) কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুরু করে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সম্ভবত প্রথম সভা অনুষ্ঠিত ৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এম, এম, নিয়াজউদ্দিন-এর সভাপতিত্বে। এই সভাতেই জনসংখ্যার পরিমাণ বিবেচনায় চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও সাদরি আদিবাসীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে এই কর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় এবং এই কার্যক্রম সার্বিকভাবে দেখাশোনা করার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন)এর সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট সরকারী- বেসরকরী সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি হঠন করা হয়। এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৩ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে, যেখানে- ক) আদিবাসী শিশুদের প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠ্য পুস্তক ও শিক্ষক নির্দেশিকা সম্পূর্ণ নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রণয়ন ও শিশুর ভর্তিযোগ্য বয়স ৫ বছর নির্ধারণ; খ) মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে চাকমা ও মারমা নিজস্ব বর্ণমালা, গারো ও ত্রিপুরা রোমান বর্ণমালা এবং ওঁরাও-দের ক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত (সাঁওতালদের ক্ষেত্রে বর্ণমালার ব্যাপারে জাতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানোনর জন্য অনুরোধ করা হয়); গ) নির্দ্দিষ্ট কিছু উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিকে (পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আইসিডিপি প্রকল্পের পরিচালক, সেভ দ্যা চিলড্রেন, অক্সফাম ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিনিধি) কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা; ঘ) ইতোমধ্যে প্রণীত প্রাক প্রাথমিক শ্রেণীর কারিকুলাম ইত্যাদি আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক কিনা পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনে সেগুলো সংশোধনের মাধ্যমে সমন্বয় করা ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় অন্যান্য অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে- শিক্ষক প্রশিক্ষ সংক্রান্ত কমিটি গঠন, টেকনিক্যাল কমিটি গঠন ও নিজ নিজ ভাষার লেখকদের সমন্বয়ে লেখক প্যানেল গঠন ইত্যাদি। আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সম্মিলিত জোট হলো এমএলই ফোরাম। সরকারি এই উদ্যোগে এমএলই ফোরামকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এমএলই ফোরার তার সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহায়তা করে থাকে। সরকারিভাবে বাস্তবায়িতব্য এই এমএলই কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে ৬টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ভাষাগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, সাদরি (ওঁরাও ও অন্যান্য) ও গারো। কিন্তু সাঁওতালরা তাঁদের বর্ণমালার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের ভাষায় শিখন শেখানো উপকরণ প্রণয়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়। তাই ১৪ জুলাই ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত এমএলই বিষয়ক সরকারের জাতীয় কমিটির সভায় আপাতত ৫টি ভাষায় উপকরণ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরী (বিষ্ণুপ্রিয়া), মণিপুরী (মৈতৈ), তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি ও বম; তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, কুড়–ক (ওঁরাও), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাষাগুলোও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে বলে আশা করা যায়।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু করার টার্গেট করা হয়েছিল, কিন্তু না কারণে তা সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তা শুরু করার জন্য আবারও টার্গেট করা হয়। কিন্তু এবারও এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এখন আমাদের সামনে রয়েছে টার্গেট জানুয়ারি ২০১৬। এবার কিন্তু আমাদের আশাবাদী যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২৬-২৭ ফেব্রæয়ারি ২০১৪ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে জাতীয়ভাবে আয়োজিত কর্মশালার মাধ্যমে ইতোমধ্যে এমএলই ব্রিজিং প্লান প্রণয়ন করা হয়েছে। গত ফেব্রæয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কালে কয়েক দফায় পাঁচ আদিবাসী ভাষার লেখক-গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত লেখক প্যানেলের মাধ্যমে প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন শেখানো উপকরণ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন বাকি রয়েছে কেবল প্রণীত উপকরণসমূহের যথার্থতা যাচাই, উপকরণ প্রকাশ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে ছেড়ে দেওয়া বা স্কুল পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা। সংশ্লিষ্ট সকলে যদি সদিচ্ছা নিয়ে তাঁদের কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখেন, তাহলে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হওয়ার কোন কারণ থাকার কথা নয়।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যেসব সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেগুলো হলো- ক) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড; খ) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ স্পেশ্যাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য বিশেষায়িত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান- পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ- রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও বিশেষ ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, এবং গ) অর্থ মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও তাদের অধীনস্থ বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসমূহ।
তিনি তার প্রবন্ধের শেষে বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো: শিক্ষা বাজেটের সুনির্দ্দিষ্ট কিছু অংশ আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ রাখা; ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে আদিবাসী ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটি ও সাব-কমিটির কার্যক্রম জোরদার করা; জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থার আলোকে জাতীয়ভাবে গৃহিত আইন, নীতি ও কৌশলের সুপারিশগুলোকে “স্থানীয়করণ” বা স্থানীয় আকাংখার সাথে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা সেভাবে বাস্তবায়ন করা; আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা; প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় (অন্তত চুড়ান্তরণের পর্যায়ে) পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত করা; জাতীয়ভাবে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা, যেখানে বাংলা ভাষার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মাতৃভাষার ব্যবহার ও এসব ভাষার উৎকর্ষ সাধনের জন্য করণীয় দিকগুলোও উল্লেখ থাকবে; আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে অব্যাহত গবেষণা পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা এবং সম্ভব হলে এই কার্য সম্পাদনের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান/ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা; সরকারিভাবে শুরু করার ক্ষেত্রে কোন জটিলতা (আর্থিক, জনবল ইত্যাদি) থাকলে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে পাইলটিং শুরু করা।