Opu Hasnat

আজ ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ২০২৪,

৩৬ গ্রাম জুড়ে পেয়ারা রাজ্য, সর্বত্র মৌ মৌ গন্ধ, পর্যটকদের ভিড়

ঝালকাঠি ভীমরুলী বাজারে বেচা-বিক্রির ধুম কৃষি সংবাদঝালকাঠিবিশেষ সংবাদ

ঝালকাঠি ভীমরুলী বাজারে বেচা-বিক্রির ধুম

বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারার ভর মৌসুম শুরু। ঝালকাঠি-বরিশাল-পিরোজপুর জেলার ৩৬ টি গ্রাম জুড়ে প্রায় ৩১ হাজার একর জমির উপর গড়ে উঠেছে পেয়ারার রাজ্য। তাই দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকা জুড়ে পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পরেছে। পাইকার এবং পেয়ারা চাষিদের বেচা কেনার ধূম চলছে পেয়ারার মোকাম (হাট-বাজার) গুলোতে। এশিয়ার বিখ্যাত এ পেয়ারাকে স্থানীয় ভাষায় গৈয়া কিংবা সবরী বলা হয়। তবে জাতীয় ভাবে এটি পেয়ারা নামে পরিচিত। আর পুষ্টিমানের দিক থেকে একটি পেয়ারা ৪ টি আপেলের সমতুল্য বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছে। তাই পেয়ারাকে ভালবেসে ‘বাংলার আপেল’ আবার কেউ ‘গরিবের আপেল’  হিসাবে গণ্য  করে।  
আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্রের অর্ধেক এই আড়াই মাস জমে উঠে পেয়ারা বেচা-কেনা। পেয়ারা চাষ ও ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে ২০ টিরও বেশি ছোট বড় ব্যবসা কেন্দ্র। স্থানীয়ভাবে বলা হয় পেয়ারার মোকাম। এ মোকাম গুলোর মধ্যে উলে¬খ যোগ্য হচ্ছে আটঘর,  কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষিরা ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে পেয়ারা নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলার যোগে নৌ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এ বছর ফাল্গুনে পেয়ারা গাছে ফুল ধরার পর অতিরিক্ত খড়ায় পানির অভাব দেখা দেয়ায় ফুল ঝড়ার পাশাপাশি অনেক গাছও মারা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পেয়ারা চাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেনি। কিন্তু তার পরেও এবার পেয়ারার ভাল ফলন  হয়েছে। কেটে গেছে চাষিদের দু:শ্চিন্তা। ঝালকাঠির কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষি জাহিদ মিয়া বলেন, আমাদের ভাগ্য ভালো খড়ার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিলো। উপরওয়ালা সহায় থাকায় পেয়ারার ফলন এবার ভালই হয়েছে। এইবার মৌসুমের শুরুতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে প্রতি মন পেয়ারা ৮শ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ ১ শ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসূমে বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ পথে পেয়ারা বাগানে আসে পর্যটকরা। পেয়ারা বাগানে এসে দেখে মুগ্ধ হয়ে এখান থেকে পেয়ারা কিনেও নিচ্ছেন পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য। 
বছরের পর বছর ধরে পেয়ারা উৎপাদিত এসব এলাকার চাষিদের একমাত্র সমস্যা হিমাগার ও সড়ক পথে যোগাযোগের যথোপযোগী ব্যবস্থা না থাকা। এ ব্যাপারে ঝালকাঠির জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষি বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল। তাই দ্রæত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারা সড়ক পথে নেয়ার কোন সঠিক ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। পেয়ারা চাষিরা জানিয়েছে, এ অঞ্চলের সাথে সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে পেয়ারা দ্রুত বাজারজাত করা যেত। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হলে পেয়ারা চাষিদের বাগান থেকে সরাসরি ট্রাক যোগে প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা পৌঁছে দেয়া এবং পচন রোধ করা সম্ভব হত। 
আড়তদার লিটন হালদার বলেন, ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম।  মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মন পেয়ারা বিক্রি হয়। তবে বাউকাঠি থেকে ভিমরুলী হয়ে কীর্তিপাশা পর্যন্ত সড়ক পথ হলে দ্রুত প্রতি দিনের পেয়ারা প্রতিদিন বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো সম্ভব হতো। ভিমরুলী মোকাম থেকে নৌ পথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালি, ভোলা, মাদারিপুর, নাটোর, বরিশাল হাজার হাজার মন পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়ক পথের যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষনিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনত। 
ব্যাংক ছাড়াই কোটি টাকার লেনদেনঃ- সভ্যতার ধারাবাহিক ঐতিহ্য কত বছর টিকে থাকে? সময়ের পরিবর্তনে সভ্যতার দৈর্ঘ্য একেক রকমের। একটি বাজার ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে দুইশ’ বছরেরও বেশি সময়। তাও আবার নদীর মধ্যে গড়ে ওঠা ভাসমান বাজার। আশ্চার্য্য হওয়ার বিষয় যে, এখানে নেই কোন চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ছিনতাইকারি, পকেটমার, নেই কোন আইন-শৃঙ্খলার নিরাপত্তার চাদর। তারপরও এখানে আসা দারুন নিরাপত্তার মধ্যেই বছরের পর বছর তাদের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। লাখ লাখ টাকা নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই তারা রাত কাটাচ্ছেন। কিন্তু, কেউ একটি টাকাও হারিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই। এলাকার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন শত শত বছরের। ঝালকাঠির সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের একটি গ্রাম ভীমরুলী। তিনটি ছোট ছোট নামবিহীন খাল মিলেছে একত্রে। যার উৎসস্থল সুগন্ধা আর সন্ধ্যা নদী। এই খাল তিনটির মোহনাতেই গড়ে উঠেছে ভাসমান বাজার। স্থানীয় আড়তদার কালু জানান, বাজারটির বয়স দু’শ বছরেরও বেশি। তিনি তার দাদাকে যে গদিতে বসে আড়তদারী করতে দেখেছেন, সেখানেই আড়তদারী করেছেন তার বাবা। এখন কালু আড়ৎদ্দারের বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। তিনি আরও জানালেন ছোটবেলায় দাদুর কাছ থেকে শুনেছেন, তারও বাবা দাদারা ঐ গদিতে বসেই ব্যবসা করেছেন। এখানে নৌকায় যেগুলোর পসরা বসে- তার মধ্যে উল্লে¬খযোগ্য হচ্ছে- পেয়ারা, আমড়া, ডাব, পেঁপে, কলা, লেবু, চালতা, মরিচ এবং বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। স্থানীয় ব্যাপারীরা জানালেন, প্রতিদিন অন্তত ৬০/৭০ লাখ টাকার কেনা বেচা হয় এই ভাসমান বাজারে। এই এলাকায় রয়েছে প্রায় ৩৬ টি গ্রাম জুড়ে পেয়ারা ও আমড়ার বাগান। বাজারের আশপাশে যথোপযুক্ত কোন পাকা সড়ক নেই বিধায়  নৌ পথই এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন তদারকি কিংবা নজরদারীও নেই। কিন্তু নির্বিঘেœই মানুষ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এই ভাসমান বাজারে। স্থানীয় ব্যবসায়ী বাকের আলী জানান, তিনি এখানে ৫০ বছরেরও বেশি ব্যবসা করে আসছেন। অথচ কোন দিন কোন ব্যবসায়ী একটি টাকা খোয়া গেছে এমন নজির নেই। তিনি বলেন এখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসেন মালামাল কিনতে। রাতে থাকার জন্য কোন হোটেল বা গেস্টহাউজ নেই। ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকা নিয়ে খোলা আকাশের  নিচেই কাটিয়ে রাত কাটিয়ে দেন। আবার সকালে নিরাপদে মালামাল কিনে যার যার গন্তব্যে ফিরে যান। নির্মল বেপারী জানান এ এলাকায় কোন চোর, ডাকাত সন্ত্রাসী পকেটমার নেই। ব্যবসায়ীরা তাই নিরাপদে ব্যবসা করতে পারেন। প্রতিদিন ফজরের আগেই খালে এসে জড়ো হয় শত শত নৌকা । সকাল ৮টা থেকে কেনা বেচা শুরু হয় চলে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। আর পেয়ারার মৌসুমে বেচাকেনা  চলে সারা দিন। আড়তদার রবি হালদার জানালেন, এখানে নির্বিঘেœ মানুষ লাখ লাখ টাকা নিয়ে পড়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ টাকার বেশি বেচা কেনা হয়। কিন্তু কাউকে খাজনা বা আড়তদারী দিতে হয় না। এখানে মানুষের বন্ধনটা খুবই দৃঢ়। আর এ কারণেই কোন নিরাপত্তা ছাড়াই তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারছেন। এলাকার মানুষেরা পাহারা দিয়ে রাখে যাতে কোন ঝামেলা না হয়। নগেন, বাবুল, সুভাষ, খোকনসহ আরও বেশ কিছু আড়তদার রয়েছেন এই ভাসমান বাজারে। ব্যবসায়ীরা জানান, এই বাজারের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এখনও হয়নি। এলাকায় কোন ব্যাংক নেই। অথচ মাসে ১৫/১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয় এই পানির ওপর। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে তাদের ব্যবসা আরো ভাল  হতো। স্থানীয় এবং বাহির থেকে আসা ব্যবসায়ীরা জানান, ভীমরুলীর এই ভাসমান বাজারই হতে পারে দৃষ্টান্ত। পুরো দেশ ভীমরুলী বাজারের মতো চাঁদাবাজমুক্ত হতে পারে যদি মানুষে মানুষের সদ্ভাব এবং বন্ধনটা ভালো হয়। সৌহার্দ্য আর সদ্ভাব কোন সভ্যতাকে যে চলমান রাখতে পারে শত শত বছর তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভীমরুলীর এই ভাসমান বাজার।

এক মণ পেয়ারায় ৩ কেজি চাল মেলে না : 'আমরা পেয়ারা বেচি ২-আড়াই টাকা কেজি। সেই পেয়ারা ঢাকায় কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। এক মণ পেয়ারা বেচে ৩ কেজি চালও মেলে না।' কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারা চাষি অজিত দুয়ারি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় পেয়ারা পুষ্টিমান সমৃদ্ধ বলে একে বাংলার আপেল বলা হয়। ঝালকাঠির চাষিরা এ পেয়ারা প্রায় শত বছর ধরে চাষ করে আসছে। সদর উপজেলার কৃর্ত্তিপাশা, ভীমরুলী, শতদাসকাঠি, খাজুরা, মিরাকাঠি, ডুমুরিয়া, জগদীশপুর, খোদ্রপাড়া, পোষন্ডা, হিমানন্দকাঠি, বেতরা, কাপড়কাঠি ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানার বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে পেয়ারা বাগান। হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বিস্তৃত এ বাগানে প্রতিবছর পেয়ারা উৎপাদিত হয়। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানকার পেয়ারা বাজারজাত করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌ-পথ। তাই প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীমরুলীর খালে বসে পেয়ারার ভাসমান হাট। ছোট ছোট নৌকায় করে চাষিরা বাগান থেকে ভাসমান হাটে নিয়ে আসে পেয়ারা। পাইকাররা পেয়ারা কিনে ট্রলারে করে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন স্থানে। শুধু পেয়ারা কিনতে নয়, বিশাল বাগান আর পেয়ারার এ ভাসমান হাট দেখতে পর্যটকরাও ঘুরতে আসে এখানে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চাষিদের পক্ষে দ্রæত পচনশীল এ ফল ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে নিয়ে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই স্থানীয় বাজারে পাইকারদের কাছে নামমাত্র মূল্যে পেয়ারা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে তারা। এ কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিনা শ্রমে বিপুল পরিমাণ মুনাফা পাচ্ছে। অন্যদিকে সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করেও পেয়ারা চাষিরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারছে না। কাপড়কাঠি গ্রামের পেয়ারা চাষি পরিতোষ বেপারী বলেন, আমার দেড় একর জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। গত বছর আমি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকলে পেয়ারা বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারতাম। তাহলে আরো বেশি লাভবান হতে পারতাম।' শতদাসকাঠি গ্রামের বিপুল হালদার বলেন, আমার এক একর ২৫ শতাংশ জমিতে পেয়ারার বাগান রয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পেয়ারার চাষ করেছি। স্থানীয় বাজারে পেয়ারা পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা পেয়ারা মহাজনদের কাছে বিক্রি করি। মহাজনরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগী মহাজন ও পাইকাররা লাভবান হচ্ছেন।' পেয়ারা চাষি ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, প্রাণ কোম্পানি জেলি তৈরির জন্য এ বছর চাষিদের কাছ থেকে কিছু পেয়ারা কিনতে শুরু করেছে। প্রতিবছর বড় বড় কোম্পানি যদি জেলি তৈরির জন্য এখান থেকে পেয়ারা কিনত, তাহলে আমরা বেশি লাভবান হতাম। আর সবচেয়ে ভালো হতো ভীমরুলী গ্রামে জেলি কারখানা স্থাপন করলে।' ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারার আড়তদার (মহাজন) লিটন হালদার বলেন, 'সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করেও পেয়ারা চাষিরা ঋণের বোঝা মুক্ত হতে পারছে না। দারিদ্র্য আঁকড়ে ধরেছে তাদের জীবনযাত্রাকে। আমরা যতটা পারি তাদের সহায়তা করি।' ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনিকা বিশ্বাস বলেন, 'কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পেয়ারা চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি, ঝালকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়ার ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে আমরা আট টন করে ফলন পেয়েছি। তবে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চাষিরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না।'

ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় বিদেশেও পাড়ি : ফরমালিনের ঝাঁজে বাজারের ফলে হাত দেয়ার জো নেই। যত ফল বাজারে মেলে এর কোনটিতে ফরমালিন নেই, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে বাজারের একমাত্র ফল বাংলার আপেল খ্যাত বরিশালের পেয়ারা, যাতে ফরমালিন মেশানো হয় না! ফলটির আঞ্চলিক নাম 'গইয়া বা গয়া'। পেয়ারার ১০০টির মতো প্রজাতি রয়েছে । পেয়ারা কম-বেশি সারা বছর দেশের বিভিন্ন বাজারে পাওয়া যায়। ফলটি খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমন পুষ্টিগুণে তুলনাহীন। দেশের অন্যসব এলাকার উৎপাদিত পেয়ারার চেয়ে বরিশাল অঞ্চলে উৎপাদিত পেয়ারার রয়েছে সুনাম। এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে বরিশালের পেয়ারা বিদেশ পাড়িও দেয়। বরিশাল বিভাগের সব স্থানে পেয়ারার ফলন হলেও উন্নত ও সুস্বাদু পেয়ারা বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে উৎপাদিত হয়। তাই ওই তিন জেলাকে বলা হয় 'পেয়ারা রাজ্য'। পেয়ারা মৌসুমের তিন মাস পাকা পেয়ারার মৌ-মৌ গন্ধে ৩৬টি গ্রামের বাতাস সুরভিত থাকে। বাগানে ১২ মাস পেয়ারার ফলন হলেও মূলত পেয়ারা মৌসুম বলতে বুঝায় আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র এই তিন মাস। পেয়ারা চাষি মিলন পাইক জানান, গুণগত মানের দিক থেকে আপেলের চেয়ে পেয়ারা উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু। কিন্তু দ্রæত পচনের কারণে পেয়ারা চাষিরা পড়েন বিপাকে। স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি ও বানারীপাড়ার সহস্রাধিক পেয়ারা চাষি ও পাইকার বাগানের ফলন নিয়ে থাকেন আতঙ্কে। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আব্দুল আজিজ ফরাজী বলেন, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় প্রতি বছর ৩১ হাজার  হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হচ্ছে। গত বছর ওই পরিমাণ জমিতে প্রায় ৮০ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত পেয়ারার বাজার মূল্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা। উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য শিল্প উদ্যোক্তাদের কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণসহ জেলি কারখানা স্থাপন করলে চাষি ও বাগান মালিকরা উপকৃত হবেন। পাশাপাশি শিল্প উদ্যোক্তারাও হবেন লাভবান। 

বাকল বিহীন ফল পেয়ারায় পুষ্টি ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ : বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারায় পুষ্টি ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ রয়েছে। একটি পেয়ারা ৪ টি আপেলের সমপরিমাণের ভিটামিন থাকে। এছাড়াও একটি কমলা লেবুর চেয়ে চারগুণ বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। প্রতিটি পেয়ারায় রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ফল। ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ২০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে, যা কমলার চেয়ে চারগুণ বেশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। পেয়ারার খোসায় কমলার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। এ ফলে লৌহ উপাদানও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান। পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পলিফেনল আছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধক। ১০০ গ্রাম পেয়ারায় পানি ৮৬.১০ গ্রাম, শক্তি ৫১ কিলো ক্যালোরি, প্রোটিন ০.৮২ গ্রাম, আঁশ ৫.৪ গ্রাম, ফসফরাস ২৫ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ৭৯২ আইইউ থাকে। এ ছাড়া পেয়ারাতে ম্যাঙ্গানিজ, সেলিনিয়াম, ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩ ইত্যাদি মূল্যবান খনিজ ও ভিটামিন থাকে। রোগ প্রতিরোধে পেয়ারার রয়েছে বহু গুণ। পেয়ারার বীজে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ পলিআন-সেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড ও আঁশ বিদ্যমান। পেয়ারা পাতার রস ক্যান্সার প্রতিরোধী এবং সংক্রমণ, প্রদাহ, ব্যথা জ্বর, বহুমূত্র, আমাশয় ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পেয়ারা সংরক্ষণ নিয়েই যত দুশ্চিন্তা : ঝালকাঠির ভীমরুলী, শতদশকাঠি, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা এবং বরিশালের বানারীপাড়ায় এবারও হয়েছে পেয়ারার বাম্পার ফলন। স্থানীয় বাজারে জায়গা দখল করে আছে দেশি পেয়ারা। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে পেয়ারা। কিন্তু মৌসুমের শুরু থেকেই পেয়ারার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে এ উপজেলার হাজার হাজার চাষি মুনাফা বঞ্চিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংরক্ষণের অভাবকেই প্রধানত দায়ী করছে চাষিরা। যুগ যুগ ধরে এ এলাকা পেয়ারার জন্য বিখ্যাত হলেও লাখ লাখ টন পেয়ারা উৎপাদন করেও ভাগ্য বদল হয়নি চাষিদের। চাষিরা জানায়, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে মৌসুমি এ ফল বছর জুড়ে ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে পারত। এ থেকে উৎপাদিত জ্যাম-জেলি দেশি বাজারের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হতো। কিন্তু ৫০ বছরেও পেয়ারা উৎপাদনকারী এ অঞ্চলে পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো হিমাগার বা জেলি প্রস্তুত কারখানা। এ ব্যাপারে চাষি নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল বলেন, এলাকার অর্ধশত গ্রামের চাষি যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষ করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প নির্মিত না হওয়ায় চাষিরা পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে। চাষিরা এ প্রতিবেদককে জানায়, উপজেলার অন্যতম পেয়ারা বাগান ভীমরুলী, শতদশকাঠি, আটঘর-কুড়িয়ানা ও বানারীপাড়া পার্শ্ববর্তি এ ৩ উপজেলার ৩৬ গ্রামের প্রায় ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া ২ হাজার ২৫টি পেয়ারা বাগানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরো এক হাজার ২৫০ জন চাষি। আর পেয়ারার চাষাবাদ ও বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে ওই সময় এলাকার প্রায় ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকে। জিন্দাকাঠি গ্রামের চাষি গোকুল চন্দ্র মজুমদার জানান, কয়েক বছরের তুলনায় এ মৌসুমে পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদিত পেয়ারার দাম তুলনামূলক কম। কিন্তু পেয়ারাবাগান পরিচর্যাসহ শ্রমের মজুরি বেশি হওয়ায় চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন বেশি হচ্ছে। কাঁচাবালিয়া গ্রামের চাষি গোপাল চন্দ্র মন্ডল জানান, কৃষিঋণ পেতে তাঁদের বিভিন্ন সময়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাঁদের দাবি, চাষিদের আর্থিক সহায়তায় সহজ শর্তে শুধু পেয়ারা চাষাবাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। ওই এলাকার পেয়ারা ও আমড়া চাষি দীনেশ মন্ডল জানান, ভীমরুলী ও আটঘর-কুড়িয়ানার ভাসমান হাট থেকে পেয়ারা বাজারজাত করতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পেয়ারা চাষিদের। আটঘর-কুড়িয়ানার ইউপি সদস্য বাবুল মন্ডল জানান, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বৃহৎ কোনো হিমাগার বা জেলি তৈরির শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে পেয়ারা চাষিরা একদিকে যেমন ন্যায্য মূল্য পেত, তেমনি উৎপাদন খরচ পুষিয়ে নিতে পারত। 

বাড়িতে বাড়িতে সুস্বাদু কাজি পেয়ারার বাম্পার ফলন : ঝালকাঠির জেলার প্রায় ৩শত গ্রামের প্রায় বাড়িতে এখন পেয়ারার ফলন চোখে পড়ার মতো। এ বছর পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এ পেয়ারা দেশি জাতের ছোট পেয়ারা নয়, কাজি পেয়ারা। অন্যান্য অঞ্চলের পেয়ারার মতো এ পেয়ারা অত্যধিক বড় না হলেও এ অঞ্চলের কাজি পেয়ারার একটা বিশেষত্ব আছে। তা হল এ পেয়ারা অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। কৃষি অফিস সূত্র জানায়, জেলার ২০৪ টি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আগে দেশীয় জাতের পেয়ারা চাষ করা হতো। কিন্তু এখন কাজি পেয়ারার চাষ অত্যধিক হারে বেড়ে গেছে। এ পেয়ারার নাম কাজি পেয়ারা হলেও এক কেজির ওপরে এ জাতের পেয়ারা খুব একটা দেখা যায় না। একাধিক গৃহস্থালি জানান, দেশি জাতের পেয়ারার গাছ অনেক জায়গা জুড়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় এ পেয়ারা গাছ লাগানো হয়। এতে অত্যধিক ফলন, বড় জাত ও মিষ্টি হওয়ায় দেশি বাংলা পেয়ারার চেয়ে এই কাজি পেয়ারা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সরেজমিন জেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় দেশি কাজি পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়েছে। বিনা খরচ ও পরিশ্রমে গ্রামের লোকজন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছে। গ্রাম্য পাইকাররা কাজি পেয়ারা প্রতিটি ৩ থেকে ৪ টাকা দরে ক্রয় করে ৫ থেকে ৮ টাকায় বিক্রি করে থাকেন। এছাড়া এই অঞ্চলের দেশি পেয়ারা অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের পেয়ারা চাষি মোঃ হানিফ হোসেন বলেন, কাজি পেয়ারার একেকটি গাছ ৮০ থেকে ১২০ টাকায় কিনে এনে একটু ভালো জায়গায় রোপণ করা হয়। তবে কোন পরিচর্যা ছাড়াই রোপণের পর থেকে প্রতি বছর একেকটি গাছ থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করা সম্ভব বলে তিনি আরও জানান। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চিন্ময় রায় বলেন, এটি বিশেষ কোন পেয়ারার জাত না হলেও এ অঞ্চলের মাটির উর্বরতা শক্তির বিশেষ গুণ থাকায় কেজি পেয়ারা বেশ সুস্বাদু হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে এ পেয়ারার চাষ ও অধিক ফলনে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দিন দিন সাফল্য বয়ে আনবে। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবেও কয়েকটি গ্রামে এ পেয়ারার চাষ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পেয়ারার মৌসুমকে ঘিরে জমজমাট ভাসমান নৌকার হাট : পেয়ারার মৌসুমকে ঘিরে জমজমাট বরিশাল অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার সীমান্তবর্তী আটঘর-কুড়িয়ানায় নৌকার হাট। মূলত বর্ষা ঋতুকে কেন্দ্র করে খাল-বিল আর নদী বেষ্টিত বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় নৌকার হাট এখানে জমে ওঠে। তবে পুরোদমে বিক্রি চলে  হেমন্ত পর্যন্ত। বর্ষা মৌসুমের পেয়ারা, আমড়া কিংবা মাছের ঘের সবখানেই নৌকা প্রধান বাহন । শুধু কৃষি কাজই নয়, এ অঞ্চলে অনেক এলাকা আছে, যেখানে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতেও নৌকার বিকল্প নেই। এখানের প্রতি হাটে দেড়-দুই লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হাটের ইজারাদার মনোজ কুমার রায়। সাধারণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে হাজারে ১০০ টাকা করে ইজারা নেওয়া হচ্ছে জানান ইজারাদার মনোজ। হাটে আসা সন্তোষ মিশ্রি নামের এক নৌকা বিক্রেতা বলেন, দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এক একটি নৌকা। বছরের চার মাস এখানে প্রতি শুক্রবার নৌকার হাট বসছে। বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশাল জেলার হাজার হাজার মানুষ শত বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। ঝালকাঠি সদর উপজেলার নবগ্রাম গ্রামের মিস্ত্রি আব্দুল খালেক বলেন,  গ্রামের সাধারণ গাছ যেমন রেইনট্রি, মেহগনি এমনকি সাড়ি চাম্বল গাছ থেকেও নৌকা তৈরি করা হয়। এক একটি নৌকা তৈরি করতে কমপক্ষে ৭ দিন লেগে যায়। হাটের ইজারার টাকা দিয়ে এক একটি নৌকা বিক্রি করে ৩০০ টাকা লাভ হয়। ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া গ্রামের মো. আব্দুল খালেক নৌকা কিনতে আসেন এই হাটে। তিনি জানান, প্রতি বছরই তিনি এ মৌসুমে ডিঙি নৌকা কিনে থাকেন। দেড়-দুই হাজার টাকায় দুই একটি করে সিজোনাল নৌকা কিনে তা দিয়েই চলাচল করেন। নৌকা তৈরির কারিগররা চরম দরিদ্র পরিবারের। পুঁজি না থাকায় এ শিল্পকে প্রসারিত করতে পারছেন না তারা। নৌকা তৈরি সামান্য আয় তাদের মৌসুমি পেশামাত্র। তাই এ শিল্পে জড়িতদের সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণ কিংবা এককালীন অনুদান দিলে নৌকা তৈরির এ পেশাকে সারা বছরের স্থায়ী পেশায় রূপান্তর করা সম্ভব বলে জানান বিক্রেতারা।

পেয়ারা বাজারজাতে বিক্রি হচ্ছে কলাপাতা : ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলী গ্রামে পেয়ারার ভাসমান হাটে বিক্রি হচ্ছে কলা পাতা। পেয়ারা বাজারজাত করণের প্রক্রিয়াগত কারণে পাইকাররা স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে কলা পাতা কিনে নিচ্ছেন। কলাপাতা বিক্রেতা  বিপুল হালদার (৬০) বলেন, এলাকার প্রতিটি পেয়ারা বাগানেই কমবেশি বিভিন্ন ধরণের কলাগাছ আছে। এছাড়াও কলাবাগান তো আছেই। প্রতিটি গাছ থেকে ২/৩টি করে কলা পাতা কেটে আনি। অনেক সময় কলাগাছের মালিকরা কলাপাতা কাটতে দেয় না। তখন তাঁদের কাছ থেকে ৫০ পয়সা দরে কিনে আনি। তবে সব দিন সমানভাবে কলাপাতা সংগ্রহ করতে পারি না। অনেকদিন ২ থেকে আড়াইশ’ কলাপাতা কেটে এনে বিক্রি করতে পারি। আবার অনেকদিন ১শ কলাপাতা কেটে আনতেই কষ্ট হয়ে যায়। পাইকারদের কাছে একেকটি কলাপাতা ১ টাকা দরে বিক্রি করি। শুধু বিপুল হালদারই নন ভীমরুলী হাটকে ঘিরে এরকম অনেকেই আছেন যারা কলাপাতা কেটে এনে বাজারের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। পাইকার পলাশ সিকদার বলেন, পেয়ারা রাখার ঝুড়িতে কলাপাতা দিয়ে রাখলে পেয়ারা দেরিতে পাকে। পেয়ারার গায়ে আচড় লেগে কালো দাগ হয় না। পেয়ারার গায়ে কালো দাগ বা কোনো স্পট পরলে ক্রেতারা ভালো দাম দিয়ে কিনতে চায় না। আমাদের এ পেয়ারা খুলনায় যাবে। তাই প্রতিটি ঝুড়িতে কলাপাতা মুড়িয়ে ভিতরে পেয়ারা রাখছি। একেকটি ঝুড়িতে ২ টি কলাপাতা দিয়ে মুড়িয়ে রাখা যায়। 

পেয়ারার হাটে চালা ভাড়া দেয়া হয় : ঝালকাঠির দু’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভীমরুলী ভাসমান পেয়ারার হাট দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। বাড়ছে বেচা-বিক্রিও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রলার যোগে আসে পেয়ারা কিনতে। স্থানীয়রা ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে চালা (টোঙ) করে ভাড়া দেয়। ব্যবসায়ীরাও চালায় বসে স্বাচ্ছন্দে পেয়ারা কিনে বাজারে সরবরাহের জন্য প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। 
জানাগেছে, বিভিন্ন আগাছা গাছের খুটির উপরে সুপারী গাছের চেরার চাউনী দিয়ে তৈরী করা হয় চালা। যা আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় টোঙ বলা হয়ে থাকে। আষাঢ়, শ্রাবন ও ভাদ্র এ ৩ মাসের জন্য ৪ হাজার টাকা করে ভাড়া দেয়া হয়ে থাকে। একেকটি চালা তৈরী করতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। একটি চালা ৩ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ভাড়া দিতে পারে। সংস্কার করলে আরো ২ বছর ভাড়া দিতে পারে। 
জগদীশপুর থেকে আসা পেয়ারা ব্যবসায়ী পলাশ সিকদার বলেন, ভীমরুলী এলাকার এক পেয়ারাচাষী চালা তৈরী করে আমাদের কাছে ভাড়া দিয়েছে। আমরা তাকে এ মৌসূমের (আষাঢ়, শ্রাবন ও ভাদ্র) ৩ মাসে তাকে ৪ হাজার টাকা ভাড়া দেই। এতে আমাদের সুবিধা হলো ট্রলারে পেয়ারা কেনার চেয়ে এখানে উঠিয়ে পেয়ারা কিনে বাছাই করতে সুবিধা হয়। বাছাই করে কাঁচা-পাকা আলাদা করে ঝুড়িতে কলাপাতা মুড়িয়ে তার মধ্যে গুছিয়ে রাখতে পারি। এতে পেয়ারার কালারের কোন অসুবিধা হয় না। 
ভীমরুলী পেয়ারার ভাসমান হাটে খালের দু’পাড়ে প্রায় ২ ডজন খানেক এভাবে চালা রয়েছে। যা স্থানীয়রা তৈরী করে পাইকারদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকে। 

ব্যাংক স্থাপনের দাবী ব্যবসায়ী ও চাষীদের : পেয়ারার মৌসূমকে ঘিরে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয় সদর উপজেলার ভীমরুলী গ্রামের ভাসমান পেয়ারার হাটে। এখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসেন মালামাল কিনতে। রাতে থাকার জন্য কোন হোটেল বা গেস্টহাউজ নেই। ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকা নিয়ে খোলা আকাশের  নিচেই কাটিয়ে রাত কাটিয়ে দেন। আতঙ্ক থাকে ডাকাতের হামলার বা দস্যুতার।   জানাগেছে, ঝালকাঠির সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের একটি গ্রাম ভীমরুলী। তিনটি ছোট ছোট নামবিহীন খাল মিলেছে একত্রে। যার উৎসস্থল সুগন্ধা আর সন্ধ্যা নদী। এই খাল তিনটির মোহনাতেই গড়ে উঠেছে ভাসমান বাজার। স্থানীয় আড়ৎদ্দার কালু জানান, বাজারটির বয়স দু’শ বছরেরও বেশী। তিনি তার দাদাকে যে গদিতে বসে আড়ৎদ্দারী করতে দেখেছেন, সেখানেই আড়ৎদ্দারী করেছেন তার বাবা। এখন কালু আড়ৎদ্দারের বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। তিনি আরও জানালেন ছোটবেলায় দাদুর কাছ থেকে শুনেছেন, তারও বাবা দাদারা ঐ গদিতে বসেই ব্যবসা করেছেন। এখানে নৌকায় যেগুলোর পসরা বসে- তার মধ্যে উলে¬খযোগ্য হচ্ছে- পেয়ারা, আমড়া, ডাব, পেঁপে, কলা, লেবু, চালতা, মরিচ এবং বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজী। স্থানীয় ব্যাপারীরা জানালেন, প্রতিদিন অন্তত ৬০/৭০ লাখ টাকার কেনা বেচা হয় এই ভাসমান বাজারে। এই এলাকায় রয়েছে প্রায় ৩৬ টি গ্রাম জুড়ে পেয়ারা ও আমড়ার বাগান। বাজারের আশপাশে যথোপযুক্ত কোন পাকা সড়ক নেই বিধায়  নৌ পথই এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন তদারকি কিংবা নজরদারীও নেই। কিন্তু মানুষ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এই ভাসমান বাজারে। স্থানীয় ব্যবসায়ী বাকের আলী জানান, তিনি এখানে ৫০ বছরেরও বেশি ব্যবসা করে আসছেন। এখানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা আসেন মালামাল কিনতে। রাতে থাকার জন্য কোন হোটেল বা গেস্টহাউজ নেই। ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকা নিয়ে খোলা আকাশের  নিচেই কাটিয়ে রাত কাটিয়ে দেন। আবার সকালে মালামাল কিনে যার যার গন্তব্যে ফিরে যান। প্রতিদিন ফজরের আগেই খালে এসে জড়ো হয় শতশত নৌকা । সকাল ৮টা থেকে কেনা বেচা শুরু হয় চলে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। আর পেয়ারার মৌসুমে বেচাকেনা চলে সারা দিন। আড়ৎদ্দার রবি হালদার জানালেন, এখানে নির্বিঘ্নে মানুষ লাখ লাখ টাকা নিয়ে পড়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ টাকার বেশী বেচা কেনা হয়। নগেন, বাবুল, সুভাষ, খোকনসহ আরও বেশ কিছু আড়ৎদ্দার রয়েছেন এই ভাসমান বাজারে। ব্যবসায়ীরা জানান, এই বাজারের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এখনো হয়নি। এলাকায় কোন ব্যাংক নেই। অথচ মাসে ১৫/১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয় এই পানির ওপর। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে তাদের ব্যবসা আরো ভাল  হতো। এ অনুন্ত যোযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানে কৃষি ব্যাংকের একটি শাখা চালু করা হলে ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও চাষীরা টাকা লেনদেন করতে পারতো। এছাড়াও পেয়ারা ও আমড়া গাছের পরিচর্যার জন্য এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়ার পরিবর্তে কৃষি ব্যাংকের এ শাখা হলে এখান থেকে সহজ শর্তে পেয়ারা চাষীরা ঋণ নিতে পারতো। 

বিক্রি হচ্ছে রাসায়নিকমুক্তবিভিন্ন ধরণের সবজিও : ঝালকাঠি সদর উপজেলার কির্ত্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলী পেয়ারার ভাসমান হাটে পেয়ারা ও আমড়া বিক্রির পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে রাসায়নিক মুক্ত বিভিন্ন ধরণের সবজিও। সবজি চাষীরা নৌকায় করে এনে তাঁদের উৎপাদিত ফসল পাইকারদের কাছে বিক্রি করছে। এখানে বিক্রি হচ্ছে আমড়া, পেঁপে, কলা, লেবু, কাকরোল, মরিচ, বেগুন, শসাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজী। ঝালকাঠির সবজির ভান্ডার খ্যাত আটঘর,  কুড়িয়ানা, ভিমরুলী, ডুমুরিয়া, শতদশকাঠি, বাউকাঠি। প্রতিদিন সকালে এসব মোকামে চাষীরা ছোট ছোট ডিঙ্গী নৌকায় সরাসরি বাগান থেকে সবজি নিয়ে আসে পাইকারদের কাছে। তা কিনে ট্রলার যোগে নৌ পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। পর্যটকরা পেয়ারা বাগান দেখতে এসে মুগ্ধ হয় পেয়ারার সাথি ফসল হিসেবে সবজি চাষ দেখেও। অনেক পর্যটক পরিবারের প্রয়োজনে রাসায়নিকমুক্ত সবজিও এখান থেকে কিনে নিয়ে যান। সবজি চাষী দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, পেয়ারার কাঁদির ফাঁকের ছোট বেড়ে (খাল) মাচা করে সবজি চাষ করা হয়। সবজি উৎপাদনের সময় কোন রকম সার বা রাসায়নিক দ্রব্য না দিয়ে জৈর সার ব্যবহার করা হয়। এতে করে সবজিতে পোকার আক্রমনও কম হয়। স্বাস্থ্য সম্মত ও সুস্বাদু সবজি উৎপাদন করা যায়।