Opu Hasnat

আজ ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ২০২৪,

কুমিল্লার ড.শাহিন উদ্ভাবন করলেন উচ্চফলনশীল জাতের ধান কৃষি সংবাদকুমিল্লা

কুমিল্লার ড.শাহিন উদ্ভাবন করলেন উচ্চফলনশীল জাতের ধান

ড. নাজমুল হক শাহিন উদ্ভাবন করলেন ৮৫০টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত। দেশি জাতের একটি ধানে সঙ্করায়ণ ঘটিয়ে তিনি এ উদ্ভাবনে সফলতা পান। তিনি একজন কৌলিতত্ত¡ ও উদ্ভিদ প্রজননবিদ এবং বায়োটেকনোলজিস্ট । বগুড়ার গাবতলী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম হাতিবান্ধা দহপাড়ায় নিজের গবেষণা মাঠে উদ্ভাবিত ধানের পরীক্ষামূলক আবাদে তিনি ফলন পেয়েছেন বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৫৪ মণ।

ড. শাহিন কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা সদরের মরহুম প্রফেসর ড. শহীদুল হক ও ডা. খাদিজা হকের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি এক সন্তানের জনক। তাঁর সহধর্মিণী হোসনে আরা নার্গিস দোলা নিজ অর্থে পরিচালিত মাতৃভাষা বিদ্যাপিঠের প্রধান শিক্ষক। বড় বোন বাকৃবির অধ্যাপক। আর ছোট ভাই বিদেশে অধ্যয়নরত। ড. হক একজন সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠক, কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রকর এমনকি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতাও।

ড. নাজমুল হক শাহিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে কৌলিতত্ত¡ ও উদ্ভিদ প্রজনন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি ও জাপানের কচি ইউনিভার্সিটি থেকে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি বাংলাদেশি ইন্ডিকা ধান জাতের উৎপত্তি ও বিবর্তনের বিষয়ে মতবাদ প্রকাশ করেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়ার বৈরী জলবায়ুর উপযোগী ধান চাষ ও নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এই আত্মভোলা বিজ্ঞানী বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুপারভাইজার ও কো-সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৯৭ সালে হাইব্রিড জাতের ধান নিয়ে গবেষণার সময় তিনি লক্ষ্য করেন দেশি ধানের জাতকেও কৃত্রিম সঙ্করায়ণের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল বানানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অন্যতম উপায় হলো ট্রান্সগ্রেসিভ সেগ্রিগেন্ট ব্রিডিং, যেখানে কৃত্রিম সংকরায়ণের পর ঋ২ পপুলেশনে ট্রান্সগ্রেসিভ সেগ্রিগেন্ট (যারা মাতৃ ও পিতৃ গাছ অপেক্ষা গুণাগুণ বিচারে সব দিক থেকেই উত্তম) খুঁজে বের করা। সঙ্করায়ণের পর ট্রান্সগ্রেসিভ সেগ্রিগেশনের ফলে বিভিন্ন খড়পর একই সঙ্গে পুনর্মিলনের ফলে খুব দ্রæত কিছু নতুন ফেনোটাইপের সৃষ্টি হয়।

তিনি ময়মনসিংহের পাহাড়ি এলাকা সুসং দুর্গাপুর গ্রামের এক কৃষকের জমিতে আমন মৌসুমে জন্মে এমন একটি জংলি ধান বেছে নেন গবেষণার বিষয় হিসেবে। সংগৃহীত (সংগ্রহকারী ড. নাজমুল হক শাহিন ও হোসনে আরা নার্গিস দোলা) ধানটি বিভিন্ন আমন ধানের জাতের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজা হয়। কিন্তু কোন জাতের সঙ্গে মিল না পাওয়ায় মৌসুম ও সংগ্রহকারী নাম অনুযায়ী নামকরণ করেন ‘দোলা আমন’।

এরপর শুরু হয় গবেষণা। সেই দোলা আমন ধানে কৃত্রিম সঙ্করায়ণ ও প্রোজেনি নির্বাচনের মাধ্যমে ড. শাহিন উদ্ভাবন করেন ৮৫০টি নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত, যা দেশি ধানের জাতের উন্নত রূপ। দীর্ঘ ১৯ বছর পর চলতি ২০১৫ সালে এসে তাঁর গবেষণার সুফল হাতে আসে। এখন তাঁর উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলোর গড় ফলন বিঘাপ্রতি ৩৩ থেকে ৪০ মণ। সর্বোচ্চ ৫৪ মন পর্যন্ত ফলন রেকর্ডে রয়েছে তার। এটা দোলা আমন ধানের সাধারণ জাতের ফলনের তিন গুণেরও বেশি। ধানের জাতগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো- ধানগাছের কাÐ ও বায়োমাস বেশি হওয়ায় প্রচন্ডগতির ঝড়েও জমিতে হেলে পড়ে না। যদিও ধানের জাতগুলোর উচ্চতা ৯৫ থেকে ১৩৫ সেন্টিমিটার। রোপণকৃত একেকটি চারায় ১০ থেকে ২৮টি পর্যন্ত কুশি উৎপন্ন হয়। প্রতিটি ধানের শীষের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩৫০টি।

নব উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো প্রচলিত ধানের জাতের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম সার প্রয়োগ করে চাষ করা সম্ভব। রোগ ও পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে। নতুন জাতগুলো আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী হবে। চাষ করা যাবে উঁচু-নিচু উভয় ধরনের জমিতে। হাওরে চাষ উপযোগী অনেক ধানের জাত এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ধানের চাল সাদা, লম্বা চিকন, মাঝারি চিকন ও মাঝারি রকমের মোটা এবং খেতে সুস্বাদু। এই ৮৫০টি ধানের জাতের মধ্যে বেশ কয়েকটি রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি ধানের জাতও আছে। এই ধানের জীবনকাল ১০৫ থেকে ১৪৫ দিন।

কৃষি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক বাংলাদেশ (দুর্গাপুর, নেত্রকোনা ও খুলনা ফার্ম) ও বাকৃবির কৃষিতত্ত¡ এবং কৌলিতত্ত¡ ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে গবেষণা করে দেখা গেছে যে উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো নাইট্রোজেন সার ব্যবহারে সাশ্রয়ী। কোনো ধরনের নাইট্রোজেন সার ব্যবহার না করে শুধু গোবর, এমওপি ও টিএসপি সার প্রয়োগ করেও ব্রি-ধান ২৯ অপেক্ষা হেক্টরপ্রতি এক টন বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। ধানের জাতগুলো তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে খাদ্যগুণ বিচারে উদ্ভাবিত ধানের নতুন জাতগুলোয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ধানের চালে সর্বোচ্চ আয়রনের পরিমাণ ৫৮.০৮ পিপিএম, যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান আয়রন সমৃদ্ধ ধানের জাত অপেক্ষা সাতগুণ বেশি। আর জিংকের পরিমাণ ৪৬.৩৮ পিপিএম, যা ব্রি-ধান ৬৪ অপেক্ষা দ্বিগুণেরও বেশি।

ড. শাহিন জানান, গত বোরো মৌসুমে তাঁর উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলোর ফলন হেক্টরপ্রতি সর্বনিম্ন ৭.৫ টন থেকে সর্বোচ্চ ১৩ টন পাওয়া গিয়েছিল। চলতি বোরো ধান ২০১৪-১৫ মৌসুমে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার হাতিবান্ধা গ্রামে কৃষকের জমিতে ৮৫০টি ধানের জাত বিভিন্ন ধরনের জমিতে কৃষকের ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ করে এখন পর্যন্ত ২৫টি জাতের হেক্টরপ্রতি ফলন মিলেছে সর্বনিম্ন ৯ টন (বিঘাপ্রতি ৩২ মণ) থেকে সর্বোচ্চ ১২ টন (বিঘাপ্রতি ৪৪ মণ)। তবে একটি জমিতে ফলন পাওয়া গেছে প্রতি বিঘায় ৫৪ মণ ধান।

স¤প্রতি বগুড়া কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক চন্দিদাস কুন্ডু ড. শাহিনের গবেষণা মাঠে গিয়ে একটি জাতের ফসল কেটে পরীক্ষা করেন। এ সময় হেক্টরপ্রতি ৯ টন (বিঘাপ্রতি ৩২ মণ) ফলন পাওয়া যায়। গবেষণা ফলাফল ভালো বলে জানান এ কর্মকর্তা।

ড. নাজমুল হক শাহীন বলেন, ‘নিজস্ব ব্যয়ে দীর্ঘ ১৯ বছর গবেষণা কাজ চালিয়ে এসেছি। গত দুই বছর ধরে বায়োটেকনোলজিস্ট আনিছার রহমান গবেষণা কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছেন। বর্তমানে পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের সার্বিক সহযোগিতা। একই সঙ্গে দরকার কৃষকদের মাঝে স্বল্পমূল্যে উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের বীজ বিতরণ করা তাহলেই কৃষক পাবে খাদ্যে নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা। সূচিত হবে দ্বিতীয় সবুজ বিল্পব।’