Opu Hasnat

আজ ২০ এপ্রিল শনিবার ২০২৪,

সুন্দরবনের অস্ত্র উদ্ধার ও বনদস্যু আত্মসমার্পনের এক বছর বাগেরহাট

সুন্দরবনের অস্ত্র উদ্ধার ও বনদস্যু আত্মসমার্পনের এক বছর

জেলে অপহরণ, হত্যা, লুণ্ঠন, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ ছিল জলদস্যুদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আর এজন্য অপরাধীরা বেছে নিয়েছিল দুর্গম সুন্দরবনকে।  

অথের প্রাচুর্যতা ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে সুন্দরবনকে পুঁজি করে জলদস্যু বা বনদস্যুরা এক প্রকার সাম্রাজ্য কায়েম করেছিল।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বিভিন্ন সময় দু-একটি বাহিনী বিলুপ্ত হলেও নতুন নামে কদিন পরই আত্মপ্রকাশ ঘটতো নতুন জলদস্যু বাহিনীর। দীর্ঘ এই সময়ে সুন্দরবনের ওপর নিভরশীল কত জেলে বাওয়ালি প্রাণ হারিয়েছে অথবা অপহরণের শিকার হয়েছে তার হিসাব নেই কারো।

৩১ মে সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু কাদের মাস্টার বাহিনীর ১০ সদস্যের অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সুন্দরবনে জেলে অপহরণ ও জলদস্যুদের নিয়ে একাধিক রিপোর্ট মিডিয়ায় প্রকাশের পর সুন্দরবনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা শুরু  হয়। বিশেষ করে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জলদস্যু বাহিনীর একের পর এক সদস্য নিহত ও তাদের আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করতে শুরু করে।

ফলে সম্প্রতি অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে সুন্দরবন ভিত্তিক জলদস্যুরা। এ অবস্থায় সুন্দরবনে দস্যুতা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে জলদস্যুরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়। তারা এ অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে লিখিত আবেদন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর। সরকারও তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়।

৩১ মে মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় বাগেরহাটে মংলার বিএফডিসি জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো বর্তমান সময়ের সব থেকে শক্তিধর জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর নেতাসহ ১০ জলদস্যু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।

এ সময় জলদস্যুরা ৫২টি বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রায় ৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়। কাদের মাস্টার বাহিনীর পর মজনু ও ইলিয়াস বাহিনী, আলম ও শান্ত বাহিনী, সাগর বাহিনী ও সর্বশেষ খোকবাবু বাহিনীসহ মোট সাত বাহিনীর ৬০ সদস্য এ সময় তাদের ব্যবহৃত ১৩৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৮ হাজার ১২৭ রাউন্ড গুলি জমা দেয়।

র‌্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবির জানান, সাধারণত ইলিশ ও শুঁটকি মৌসুমকে কেন্দ্র করে জলদস্যু বা বনদস্যুরা ডাকাতি, অপহরণ এবং অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশ ও শুঁটকি মৌসুমে সুন্দরবন এলাকায় যাতে মৎস্য আহরণকারী জেলেদের জলদস্যু বা বনদস্যুদের শিকারে পরিণত হতে না হয় সেজন্য সুন্দরবন এলাকায় বিশেষ অভিযান চলছে।  

গত ৩১ মে সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু মাস্টার বাহিনীর ১০ জন জলদস্যু ৫২টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রায় ৪ হাজার ৫০০ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দিয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ জুলাই সুন্দরবনের কুখ্যাত জলদস্যু মজনু ও ইলিয়াস বাহিনীর ১১ জন জলদস্যু ২৫টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১ হাজার ২০ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়।

গত ৭ সেপ্টেম্বর জলদস্যু আলম ও শান্ত বাহিনীর ১৪ জন জলদস্যু ২০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মোট ১ হাজার ৮ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়।

১৯ অক্টোবর সাগর বাহিনী ২০টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫৯৬ রাউন্ড বিভিন্ন প্রকার গোলাবারুদ জমা দেয়।

সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর খোকাবাবু বাহিনীর ১২ সদস্য ২২টি দেশি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১ হাজার ৩ রাউন্ড গোলাবারুলসহ র‌্যাব-৮ এর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

বেশ কিছু জলদস্যু বা বনদস্যু বাহিনীর আত্মসর্মপণের পর সুন্দরবনে তাদের তৎপরতা বহুলাংশে কমে এসেছে বলে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা দাবি করেন।

২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সুন্দরবনে চাঁদপাই রেঞ্জের চরপুটিয়া খালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে কুখ্যাত বনদস্যু মজনু বাহিনীর উপপ্রধান সাতক্ষীরা জেলার অধিবাসী মশিউর রহমান (২৯)। এসময়ে র‌্যাব সদস্যরা বন থেকে দস্যুদের ব্যবহৃত ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে।

৩ মার্চ সুন্দরবনে কচিখালী কটকা ও পাথরঘাটা সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৭ জেলেকে জলদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে। এরপর ১০ মার্চ সুন্দরবনের কচিখালী চান্দেশ্বর খালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বরগুনার পাথরঘাটা এলাকার জলদস্যু মো. মনির (২৫) চট্টগ্রাম এলাকার তিন জলদস্যু মো. এনাম (৩৫), মো. গিয়াস উদ্দিন (২৫) ও মো. হাসান (২২) নিহত হয়।

এসময় দস্যুদের ব্যবহৃত ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। ৬ মে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর আন্দারমানিক মৃগমারী খালে বন্দুকযুদ্ধে আলম বাহিনীর প্রধান বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ এলাকার বনদস্যু মো. আলম খান (৩৫) নিহত হয়। এসময়  র‌্যাব সদস্যরা ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে।

র‌্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবির জানান, বিশাল সুন্দরবনের উপর নিভশীল হাজার হাজার উপকূলবর্তী মানুষ প্রতিনিয়তই বনদস্যু বা জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়। সুন্দরবনসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় বনদস্যু, জলদস্যুদের দমনের লক্ষে র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স কাজ করছে। র‌্যাব সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যু ও বনদস্যুদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে।

তিনি আরও জানান, র‌্যাব প্রতিষ্ঠা হতে এ পর্যন্ত সফল অভিযানে ৬৫২টি অস্ত্র, ১৮ হাজার ৫৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধারসহ ২২৬ জন জলদস্যুকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে সুন্দরবনকেন্দ্রিক বনদস্যু বা জলদস্যু বাহিনীর অপতৎপরতা বহুলাংশে কমে এসেছে।